বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৮:১৭ পূর্বাহ্ন

পথ বিএনপির, হাঁটছে আ.লীগ

বর্তমানকণ্ঠ ডটকম / ১০৭ পাঠক
বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৮:১৭ পূর্বাহ্ন

নিউজ ডেস্ক,বর্তমানকণ্ঠ ডটকম,বৃহস্পতিবার,
০৮ ফেব্রুয়ারী ২০১৮:

পথ বিএনপির, হাঁটছে আ.লীগস্বাধীনতার পর থেকে পালাক্রমে বাংলাদেশ পরিচালনা করছে বড় দুটি রাজনৈতিক দল। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। দেশ পরিচালনা ও বিরোধী দলের দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতাও দুই দলের প্রায় সমান। আওয়ামী লীগ একটি পুরনো আর বিএনপি অপেক্ষাকৃত একটি নতুন রাজনৈতিক দল হিসেবে পরিচিত। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে মোটা দাগে তেমন কোন পার্থক্য নেই। চেতনাগত কিছু পার্থক্য ছাড়া (যদিও দুই দলকে একই পাল্লায় মাপার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ নেতাদের অনেকেরই আপত্তি রয়েছে)। যতই দিন যাচ্ছে এই দুই দলের পার্থক্যও কমে আসছে। দেরিতে হলেও তারা অর্থনীতি রাজনীতি বা অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতিতে প্রায় একই সুরে কথা বলছে।
বিশ্ব রাজনীতিতে ঠান্ডা যুদ্ধ শেষ হওয়ার পথে। আশির দশকের শেষে ভেঙ্গে যায় সমাজতন্ত্রের মহীরূহ সোভিয়েত ইউনিয়ন। ইউরোপের অনেক দেশ তখন সমাজতন্ত্রের ধারা থেকে বের হয়ে আসতে থাকে। সে সময় বাংলাদেশে প্রথম অন্তবর্তীকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচনে জয়লাভ করে বিএনপি ১৯৯১ সালে ক্ষমতায় আসে। বিএনপি সরকার মুক্তবাজার অর্থনীতি চালু করে বাংলাদেশে। সে সময় তাদের সফল অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান সমালোচিত হন এ নীতি গ্রহণ করায়। আওয়ামী লীগ ছিলো মুক্তবাজার অর্থনীতির ঘোর বিরোধী। তাদের দলীয় মেনিফেষ্টতে সমাজতন্ত্রের কথা লেখা ছিল। আওয়ামী লীগ সমাজতন্ত্রকে আঁকড়ে ধরে ছিল। মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে তারা মুক্তবাজার অর্থনীতিকে গ্রহণ করে।
পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই সামরিক বাহিনীর কম বেশি ভূমিকা থাকে রাজনীতিতে। বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এ প্রভাব ব্যাপক। বলা হয়ে থাকে বিএনপি ক্যান্টনমেন্টে জন্ম নেওয়া একটি রাজনৈতিক দল। বিএপির সঙ্গে সামরিক বাহিনীর সখ্যতা সব সময়ই ছিল। সামরিক বাহিনীর কতিপয় উচ্ছৃঙ্খল সদস্যদের হাতে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পরও। সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখেই তারা চলেছে। বিএনপির রাজনীতিতে সাবেক সেনা প্রধানসহ বিভিন্ন স্তরের সাবেক সামরিক কর্মকর্তাদের অতীতের মত বতর্মানেও সরব দেখা যাচ্ছে।
স্বাধীনতার পর রক্ষী বাহিনী গঠন ও অন্যান্য কারণে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সামরিক বাহিনীর বিরোধ দেখা দেয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট ও ৩ নভেম্বরের ঘটনায় সে বিরোধ ডালপালা বিস্তার করে এবং একটা বৈরী সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল দীর্ঘদিন। ১৯৯৬ সালে ২১ বছর পর ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ এবং সে বরফ কিছুটা গলতে শুরু করে। ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর দৃশ্যপট অনেকটা বদলে যায়। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে এখন অনেক সাবেক সামরিক কর্মকর্তাদের আনাগোনা। হিসেব করলে দেখা যাবে বিএপির চেয়ে বেশি। সামরিক বাহিনীর সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির জন্য বর্তমান সরকার অনেক বেশি আগ্রহী আগের চেয়ে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তার বিভিন্ন ভাষণে সে বিষয়ে পরিষ্কার করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘সশস্ত্র বাহিনী দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহযোগীর ভূমিকা পালন করবে। আর এভাবে তারা দেশের মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করবে।’
স্বাধীনতা পূর্ব ও উত্তর বাংলাদেশের রাজনীতিতে জোটবদ্ধ আন্দোলন ও নির্বাচন করার রেওয়াজ শুরু হয়। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়ই জোটবদ্ধ আন্দোলন ও নির্বাচন করেছে। ৭৫ এর পট পরিবর্তনের পরে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশে বহু মতের রাজনীতির চর্চা শুরু করেন। তিনি জাগদল থেকে জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট গঠন করেন। তার এ দল মুসলিম লীগ, ন্যাপ (ভাসানী), আওয়ামী লীগ, জাসদ, ইউ.পি.পিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতা ও কর্মীদের নিয়ে গঠন করেন। ১৯৯১ ও ১৯৯৬ এর নির্বাচন এককভাবে করলেও ২০০১ ও ২০০৮ এর নির্বাচন তারা জোটবদ্ধ হয়ে করেছে। আগামী নিবার্চনও তারা জোটবদ্ধ হয়ে অর্থাৎ ২০ দলীয় জোটের ব্যানারেই করবে এমন ঘোষণাই দিয়েছে।
অতীতে আওয়ামী লীগও জোটের রাজনীতি করেছে। কিন্তু সেখানে তাদের সমমনা দলের সঙ্গেই তারা জোট করেছে। ২০০৮ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জোটে বাম দলের পাশাপাশি ইসলামপন্থী দলও ছিল। বিভিন্ন মত পথের দলকে নিয়ে তারা নির্বাচনে জয়লাভ করে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নিবার্চনেও তারা একই ধরনের জোট করেছে। আগামী নির্বাচনও তারা জোটবদ্ধ হয়েই করবে। এবং এ জোট আরও সম্প্রসারিত হতে পারে। সেখানে বিভিন্ন মত পথের দল থাকবে এমন আভাসই পাওয়া যাচ্ছে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার অতীতে ছিল বর্তমানে আছে এবং ভবিষ্যতেও হয়তো থাকবে। ১৯৯১ এর নির্বাচনে শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়া সিলেটে হযরত শাহজালাল (রহ.)-এর মাজার জিয়ারতের মাধ্যমে তাদের নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেন। এ ধারা এখন রাজনীতিতে রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহারের অভিযোগ বিএনপির বিরুদ্ধে অনেকেই করে থাকেন। জন্মের পর থেকেই বিএনপির সঙ্গে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের সখ্যতা ছিল। মুসলিম লীগ, জামায়াত ইসলামী বাংলাদেশ, ইসলামী ঐক্যজোট, খেলাফত মজলিশের পাশাপাশি ছোট ছোট ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ঘনিষ্টতা আছে।
এ বাপারে আওয়ামী লীগ অভিযোগ করে থাকে যে বিএনপি ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করে। কিন্তু তারাও ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলছে। ২০০৮ এর নির্বাচনের আগে তারা খেলাফত মজলিশের সঙ্গে চুক্তি করেছিল। পরে তারা সে চুক্তি থেকে সরে আসে প্রতিবাদের মুখে। সরে আসলেও অন্য ইসলামী দলকে তারা সঙ্গে নিয়েছে তাদের ১৪ দলীয় জোটে। ২০১৮ নির্বাচনকে সামনে রেখে হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। হেফাজতে ইসলামকে নানাভাবে তুষ্ট করার চেষ্টা করছে। ছোট ছোট ইসলামী দলের অনুষ্ঠানে মন্ত্রী এমপিরা অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণ করে ধর্মের কথা বলছেন।
উওরাধিকারের রাজনীতির জন্য ভারতীয় উপমহাদেশের ভূমি উর্বর। শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনা ও জিয়াউর রহমানের সহধর্মিনী খালেদা জিয়া। মুজিব ও জিয়ার উত্তরাধিকারী হিসেবে বিশেষ পরিস্থিতিতে রাজনীতিতে আসাকে জনসাধারণ মেনে নিয়েছে। আজ তারা নিজেদের যোগ্যত্যায় উজ্জল। কিন্তু যখন তৃতীয় প্রজন্ম যুক্ত হয় তখন পারিবারিক রাজনীতির ধারা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। খালেদা-হাসিনার পরের প্রজন্মকে মেনে নেবে কি-না তা নিয়ে সংশয় ছিল রাজনৈতিক অঙ্গনে। ২০০১ এ চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় এসে তারেক রহমানকে বিএনপির ১ নম্বর সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব পদে অধিষ্ঠিত করেন। যদিও তারেক রহমান পরোক্ষভাবে ১৯৯১ থেকে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
সর্বশেষ কাউন্সিলে তারেক রহমানকে তার অনুপস্থিতিতে দলের ভাইস চেয়ারম্যান নিযুক্ত করা হয়। গুজব রয়েছে তারেক রহমানের স্ত্রী ডা. জোবায়েদা রহমান রাজনীতিতে আসতে পারেন। তাদের কন্যা জাইমা রহমানকে নিয়েও কথা উঠেছে। উওরাধিকারের রাজনীতি সম্পর্কে আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনা অতীতে নানা কথা বলেছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়কে তার তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা নিয়োগ করেছেন। আর এভাবেই আওয়ামী লীগের ভবিষ্যত নেতা হিসেবে সজীব ওয়াজেদ জয় সামনে চলে আসছেন রাজনীতির ময়দানে। বিভিন্ন সেমিনার সিম্পোজিয়াম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তিনি সরব রয়েছেন। গুঞ্জন রয়েছে শেখ হাসিনার ছোটবোন শেখ রেহানা ও মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল রাজনীতিতে আসতে পারেন।
’পূর্বদিকে তাকাও’(To look at the east) এ শ্লোগান সামনে নিয়ে ২০০১ সালে চারদলীয় জোট সরকার পূর্বমুখী অর্থনৈতিক পলিসি নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়। তখন অনেকে এ নীতির সমালোচনা করেছিলেন। সমালোচনার জবাবে তৎকালীন সরকার বলেছিল, ’ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আমরা পশ্চিম কিংবা অন্য কোন দিকের দুয়ার বন্ধ করছি না, বরং পূর্বদিকে আরেকটি নতুন সম্ভাবনার দুয়ার উন্মুক্ত করছি।’ এরপর পার হয়ে গেছে এক যুগের বেশি সময়। আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীন জাপান সফরের মাধ্যমে পূর্ব দিকে তাকানোর গুরুত্ব স্বীকার করেছেন। পশ্চিম ছেড়ে পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর দিকে চোখ পড়েছে তাদের। বাজার সম্প্রসারণে পূর্বমুখী নীতির বাস্তবায়ন ঘটাতে আরও ছয়টি দেশে বাণিজ্যিক মিশন স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বর্তমান সরকার, যার তিনটি হচ্ছে পূর্ব এশিয়ায়। এর মধ্যে চীনের কুনমিং, দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউল ও সিঙ্গাপুরকে বেছে নেয়া হয়েছে। বর্তমান সরকার এখন বিএনপির দেখানো সে পথেই হাটছে।
বলা হয়ে থাকে, ‘বাঙালি আজ যা ভাবে ভারত কাল তা ভাবে।’ এ কথার সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলা যায় বাংলাদেশের রাজনীতিতে বাংলাদেশ জাতীয়তাবদী দল (বিএনপি) আজ যা ভাবে, আওয়ামী লীগ কাল তা ভাবে। বিএনপিকে পদে পদে অনুসরণ করছে আওয়ামী লীগ। তারা সরে আসছে তাদের নীতি ও আর্দশ থেকে। বিএনপি তার নীতি ও আদর্শে অবিচল রয়েছে। অনেক দেরিতে হলেও বিএনপির দেখানো পথে আজ আওয়ামী লীগ হাঁটছে। তাহলে এ কথা বললে কি খুব বেশী ভুল হবে ‘পথ বিএনপির, হাঁটছে আওয়ামী লীগ।’

মাসুদ কামাল হিন্দোল : সাংবাদিক ও রম্যলেখক
hindol_khan@yahoo.com


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *