শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ১১:৫১ পূর্বাহ্ন

কাজ নেই বেতন নেই দিশেহারা প্রবাসী

বর্তমানকণ্ঠ ডটকম / ৪২ পাঠক
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ১১:৫১ পূর্বাহ্ন
কাজ নেই বেতন নেই দিশেহারা প্রবাসী

ডেস্ক নিউজ, বর্তমানকন্ঠ ডটকম : চুক্তি ভিত্তিক কর্মক্ষেত্রে কাজ নেই বেতন নেই এটাই বাস্তব । দিন মজুর প্রবাসীর সংখ্যা নেহায়েত কম নয় । বৈধ চ্যানেলে বেশীর ভাগ রেমিট্যান্স প্রেরণ করে থাকেন প্রবাসী এই দিন মজুররা । দালাল ভিসা কারবারিদের ফাঁদে পড়ে সহায় সম্বল বিক্রয় করে চাকুরী নামের সোনার হরিনের আশায় প্রিয়জনদের ছেড়ে প্রবাসে গিয়ে চুক্তি অনুযায়ী কাজ না পেয়ে আগে থেকেই কর্মহীন জীবনযাপন করছেন অনেকে।প্রতারিত শ্রমিক ছাড়াও করোনার আঘাতে স্হবির বিশ্বে কর্মহীন কর্মীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে । বর্তমান বৈশ্বিক করোনা মহামারীতে আক্রান্ত দেশগুলোয় লকডাউন বা জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে কিংবা এমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে যাকে এক কথায় বলা চলে অচলাবস্থা। এমতাবস্থায় বিভিন্ন দেশে কর্মরত লাখ লাখ প্রবাসী বাংলাদেশি কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশে টাকা পাঠানো দূরে থাক, তাদের থাকা-খাওয়াই কঠিন হয়ে পড়েছে। তদুপরি মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশের সরকার প্রবাসীদের নিজ দেশে ফেরানোর তাগিদ দিচ্ছে। সব মিলিয়ে, দেশের অর্থনীতিতে এটি মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বিদেশে কর্মরত শ্রমিকদের বিষয়ে করণীয় নির্ধারণে ৫ এপ্রিল বৈঠকে বসছে সরকার। এতে প্রবাসীকল্যাণ, পররাষ্ট্র, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর প্রতিনিধিরা থাকবেন।

এ বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, বিষয়টি অত্যন্ত জটিল। প্রবাসীদের অনেকেই কর্মহীন। অনেকেরই কাজ থাকবে না। অনেককে পাঠিয়ে দিতে চাইছে সেসব দেশের সরকার। বহু দেশ বাংলাদেশের শ্রমিকদের ফিরিয়ে আনতে বারবার তাগিদ দিচ্ছে, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। যারা সেসব দেশের জেলে আছেন, তাদের এখনই নিজ খরচে ফেরত পাঠাতে চায় দেশগুলোর সরকার। সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়বেন যারা অবৈধভাবে আছেন। আমরা আমাদের সব মিশনকে নির্দেশ দিয়েছি, প্রবাসীদের সর্বোচ্চ সহযোগিতা করতে। এ ছাড়া আরও করণীয় ঠিক করতে আমরা বৈঠকে বসছি।

প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সূত্র মতে, বর্তমানে এক কোটি ২০ লাখেরও বেশি বাংলাদেশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মরত আছেন। বর্তমানে সর্বাধিক ২০ লাখ ৮৪ হাজার বাংলাদেশি রয়েছেন সৌদি আরবে। সংযুক্ত আরব আমিরাতে ১৩ লাখ ৭০ হাজার এবং ওমান ও মালয়েশিয়ায় আছেন ১০ লাখেরও বেশি বাংলাদেশী। এরপর কাতার, কুয়েত, সিঙ্গাপুর ও বাহরাইন। ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে সর্বাধিক বাংলাদেশি আছেন ইতালিতে। প্রাণঘাতী করোনার কারণে দেশগুলোয় সব প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় তাদের অধিকাংশই কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। এর মধ্যে যারা রোজ বা সপ্তাহের ভিত্তিতে কর্মরত ছিলেন, তারা পড়েছেন মহাসংকটে। আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন প্রবাসের ব্যবসায়ীরাও। অনেকের নিয়োগকর্তা বেতন, খাদ্য, বাসস্থান, ওষুধ ইত্যাদি দিলেও যাদের নির্দিষ্ট নিয়োগকর্তা নেই, বিভিন্ন জায়গায় কাজ করছেন, তাদের আয় একেবারেই নেই। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় অধিকাংশ প্রবাসী কর্মহীন হয়ে পড়ার কারণে বেতন পাবেন না। বাংলাদেশের রেমিট্যান্সের মূল উৎস মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমিকরা।

যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও মধ্যপ্রাচ্যের একাধিক প্রবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, করোনা সংক্রমণের ভয়ে তারা ঘরের বাইরে যেতে পারছেন না। দিন যত যাচ্ছে, তাদের দুশ্চিন্তা ততই বাড়ছে। কয়েকটি দেশে যারা বৈধ ওয়ার্ক পারমিট নিয়ে কাজ করছেন, তাদের অর্ধেক বেতন দেওয়া হবে বলে জানানো হয়েছে। আর যাদের ওয়ার্ক পারমিট নেই, তাদের অবস্থা খুবই সঙ্গীন এবং তাদের সংখ্যাও কম নয়।

অর্থনীতিবিদদের মতে, চলতি মাসে বাংলাদেশের রেমিট্যান্স প্রবাহ মারাত্মকভাবে কমে যাবে। এ সংকট কয়েক মাস চলতে থাকলে দেশের পুরো অর্থনীতিতেই মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এ ছাড়া দেশে পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে একটি বাজার-সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে অনেক বছরের ধারাবাহিকতায়। এবার পহেলা বৈশাখের আগে মার্কেট ও বিপণিবিতানগুলো বন্ধ থাকলে ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের। করোনার প্রভাব যত দীর্ঘায়িত হবে, রেমিট্যান্সসহ অন্য অনেক খাতেই তার প্রভাব ততই মারাত্মক হবে। এ ছাড়া রমজান মাসকে ঘিরে যে ব্যবসায় প্রবাহ রয়েছে, সেটিও বিঘ্নিত হবে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, করোনার প্রাদুর্ভাবে রেমিট্যান্সের ওপর অবশ্যই নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তিনি বলেন, প্রথমত যেসব শ্রমিক দেশে ফিরে এসেছেন, তারা কাজ করতে পারছেন না; দ্বিতীয়ত, বিদেশি কোম্পানিগুলো নতুন করে নিয়োগ দেবে না এবং তৃতীয়ত, মধ্যপ্রাচ্যসহ অন্যান্য দেশে অর্থনৈতিক মন্দার কারণে শ্রমিক ছাঁটাই করা হবে। তিনি জানান, গত জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত রেমিট্যান্স প্রবাহ ভালো থাকলেও গত জানুয়ারি থেকে নেতিবাচক ধারায় রয়েছে। এটা আরও ঘনীভূত হবে, আশঙ্কা করছেন তিনি।

এদিকে প্রবাসীদের নগদ অর্থ সহায়তা দেওয়ার পরিকল্পনা করছে সরকার তাদের খাদ্য, আবাস, ওষুধ ও অন্যান্য প্রয়োজনে। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় বলছে, বিভিন্ন দেশের দূতাবাসগুলো থেকে তাদের চাহিদা সম্পর্কে তথ্য দিতে বলা হয়েছে। সে তথ্য প্রাপ্তির পর সহায়তার পরিমাণ নির্ধারণ হবে। প্রবাসী বাংলাদেশিদের সব ধরনের সহায়তা দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে সংশ্লিষ্ট মিশনগুলোকে। এমনকি করোনায় কেউ আক্রান্ত হলে তার চিকিৎসাসেবা প্রদানসহ কেউ মারা গেলে তাকে নগদ অর্থসহায়তা প্রদানের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

গত বুধবার প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমদের সভাপতিত্বে করোনা ভাইরাস সংক্রান্ত মনিটরিং কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভার তথ্যানুযায়ী, প্রবাসী-অধ্যুষিত রাষ্ট্রগুলোয় শ্রমিক উইংয়ের মাধ্যমে প্রতিদিনই সংশ্লিষ্ট দেশের করোনা ভাইরাস পরিস্থিতি ও প্রবাসী কর্মীদের স্বাস্থ্যগত অবস্থার প্রতিবেদন আসছে। প্রবাসী শ্রমিকদের ভালোমন্দ দেখভালের দায়িত্ব প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের। করোনা ভাইরাস সংক্রান্ত মনিটরিং কমিটির সর্বশেষ সভায় উল্লেখ করা হয়েছে, প্রবাসীদের জন্য ১২টি কার্যক্রম বা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে প্রবাসী ও বিদেশগামী কর্মীদের ভিসার মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার বিষয়ে প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী জিসিসিভুক্ত (মধ্যপ্রাচ্যের) দেশগুলোর দূতাবাস প্রধানদের সঙ্গে বৈঠক করে মেয়াদ বাড়ানো আশ্বাস দেন; সব শ্রম কল্যাণ উইংকে পরিস্থিতির হালনাগাদ প্রদান এবং সংশ্লিষ্ট দেশে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের চাহিদা অনুযায়ী সর্বাত্মক সহযোগিতা দেওয়ার নির্দেশ; অতিরিক্ত সচিবকে (মিশন ও কল্যাণ) করোনা সংক্রান্ত কার্যক্রমের ফোকাল পারসন মনোনয়ন এবং তার নেতৃত্বে বিভিন্ন অংশীজনের সমন্বয়ে একটি মনিটরিং কমিটি গঠন। মিশন ও কল্যাণ অনুবিভাগ সংশ্লিষ্ট সব অংশীজনের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ, বায়রা ও এনজিওগুলোর মাধ্যমে এ সংক্রান্ত প্রচারণা এবং শ্রম কল্যাণ উইং, টিটিসি, আইএমটি, সাপোর্ট সেন্টারের সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ, পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ; করোনার প্রাদুর্ভাবে বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি কর্মী এবং দেশে ফেরত আসা কর্মীদের সম্ভাব্য সংকট মোকাবিলায় কীভাবে কী ধরনের সহযোগিতা দেওয়া যায় এ বিষয়ে ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের (প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ সংস্থা) সভায় নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং মিশনের চাহিদা অনুযায়ী সর্বোচ্চ সব রকম সহযোগিতার জন্য আর্থিক বরাদ্দ।

বায়রা মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান বলেন, করোনা ভাইরাসের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য সরকার, বায়রা, বিদেশি স্টেকহোল্ডার একসঙ্গে কাজ করছে। ইতোমধ্যে প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী সংশ্লিষ্ট স্টেকহোলডারদের নিয়ে একটি কমিটি করে দিয়েছেন। ওই কমিটি সুপারিশ করেছে, কোনো শ্রমিক দেশে ফিরে এলে তাকে নগদ ৫ হাজার টাকা প্রদানের। এ ছাড়া তার সুরক্ষা দিতে যা যা প্রয়োজন, সরকারের পক্ষ থেকে তা দেওয়া হবে। তিনি আরও বলেন, বিদেশে যারা রয়েছেন তাদের সব ধরনের সহায়তা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে সংশ্লিষ্ট মিশনগুলোকে। এমনকি করোনায় কেউ আক্রান্ত হলে চিকিৎসাসেবার পাশাপাশি যদি কেউ মৃত্যুবরণ করে তাকে নগদ সহায়তা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।

বায়রা মহাসচিব আরও বলেন, বিদেশে শ্রমিক পাঠানোর সঙ্গে সঙ্গে তাদের প্রত্যেকের জন্য সাড়ে তিন হাজার টাকা করে কল্যাণ ফান্ডে রাখা হয়। এ দুর্যোগকাল ওই ফান্ড দিয়েই মোকাবিলা করা হবে।

এদিকে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের করে দেওয়া ক্রাইসিস কমিটির প্রধান অতিরিক্ত সচিব ড. আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন গতকাল বলেন, মন্ত্রীর নির্দেশে আমরা একযোগে কাজ করে যাচ্ছি। বিদেশে কর্মরত সব শ্রমিকের খোঁজখবর নিতে ইতোমধ্যে মিশনগুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তারা কাজ করছেন। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর অনেক শ্রমিককে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে। করোনা ভাইরাস আক্রান্তদের চিকিৎসাসেবায় মিশনগুলো কাজ করছে।

এক প্রশ্নের জবাবে ড. আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন বলেন, আমরা সবাই চিন্তিত। সমস্যা দীর্ঘায়িত হলে শ্রমিকরা চাকরি হারাবেন, দেশে ফিরে আসবেন। এক্ষেত্রে এসব শ্রমিকের পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হবে, ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশ। এসব বিষয় ভাবনায় রেখে বর্তমান, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে বিদেশে কর্মরত শ্রমিকদের জন্য কী করণীয় এ নিয়ে ৫ এপ্রিল প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সব স্টেকহোল্ডারদের নিয়ে বৈঠক হবে। সেখানে যথার্থ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে বলে মনে করি।

নভেল করোনা ভাইরাসের ব্যাপক সংক্রমণে টালমাটাল গোটা বিশ্ব। পরস্পরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশ। আক্রান্ত দেশগুলোয় বন্ধ হয়ে গেছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, দোকানপাট, অফিস-আদালত, কল-কারখানা। এমতাবস্থায় বেকার হয়ে পড়েছেন লাখ লাখ প্রবাসী বাংলাদেশি। সর্বাধিক সমস্যায় পড়েছেন দৈনিক বা সাপ্তাহিক চুক্তির ভিত্তিতে কর্মরত ছিলেন যেসব প্রবাসী শ্রমিকরা এবং যারা অবৈধভাবে আছেন তারা। ইতোমধ্যে বিভিন্ন দেশে ৫৫ জনের মতো বাংলাদেশি করোনায় মারা গেছেন; আক্রান্ত হয়েছেন কয়েকশ বাংলাদেশি।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *