শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০১:২৩ পূর্বাহ্ন

বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক মানস ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের দার্শনিক ভিত্তি

বর্তমানকণ্ঠ ডটকম / ৩৬ পাঠক
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০১:২৩ পূর্বাহ্ন

অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান, বর্তমানকন্ঠ ডটকম : একটি স্বাধীন সার্বভৌম আধুনিক রাষ্ট্র তৈরি করে দিয়ে গেছেন আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এটা তিনি কীভাবে করলেন সেটা শুধু তাঁর রাজনৈতিক দর্শন নিয়ে আলোচনা করলেই বোঝা যায়। ইবনে খালদুন, হিস্টোরিগ্রাফির জনক ১৩৭৭ সালে তাঁর বিখ্যাত বই মোকাদ্দিমা’য় লিখে গেছেন, যে প্রেক্ষাপটে একটা ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটে এই প্রেক্ষাপট কেউ বিস্তারিত না জেনে কোনো কিছু উপস্থাপন করলে, ঐ আলোচনাটা পূর্ণাঙ্গ হয় না (Khaldun, ১৯৬২)। বাংলাদেশ নামক এই যে রাষ্ট্রটার আমরা মালিক সেটা কীভাবে আমরা পেলাম, কি অবস্থায় এটা তৈরি হলো এর প্রেক্ষাপটটা একটু বলি। প্রথমে আমি অবিশ্বাস দিয়ে শুরু করতে চাই। কারণ অবিশ্বাস হচ্ছে কোনো কিছু শুরু করার জন্য ভালো কাজ। এটা আবার আমি বলছি না, রেনে দেকার্তে, ফরাসি দার্শনিক ১৬৩৭ সালে ‘Discourse on Method’ বইয়ে বলে গেছেন। কোনোকিছু শুরু করার সময় অবিশ্বাস দিয়ে শুরু করতে হয়। সাম্প্রদায়িকতার ব্যাপারে আমি একটা অবিশ্বাস দিয়ে শুরু করতে চাই। আসলে ‘আমরা কখনই অসাম্প্রদায়িক ছিলাম না’। আমাদের সমাজে বহু আগে থেকেই সাম্প্রদায়িকতা ছিল।১ আমি একটি উদাহরণ দেই, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন
“আমার এক বন্ধু ননীকুমার দাস, একসাথে পড়তাম, কাছাকাছি বাসা ছিল, দিনভরই আমাদের বাসায় কাটাত এবং গোপনে আমার সাথে খেত। ও ওর কাকা’র বাড়িতে থাকত। একদিন ওদের বাড়িতে যাই। ও আমাকে ওদের থাকার ঘরে নিয়ে বসায়। ওর কাকীমাও আমাকে খুব ভালবাসত। আমি চলে আসার কিছু সময় পরে ননী কাঁদো অবস্থায় আমার বাসায় এসে হাজির। আমি বললাম, ‘ননী কি হয়েছে?’ ননী আমাকে বলল “তুই আর আমাদের বাসায় যাস না। কারণ, তুই চলে আসার পরে কাকীমা আমাকে খুব বকেছে তোকে ঘরে আনার জন্য এবং সমস্ত ঘর আবার পরিষ্কার করেছে পানি দিয়েও আমাকেও ঘর ধুতে বাধ্য করেছে (রহমান, ২০১২: পৃ. ২৩)।”

১৯৩৭ সালের বঙ্গীয় প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনের কথা আমরা জানি। আজকে আমাদের ইসলামী জাগরণের কবি, যিনি অনেক ইসলামী গজল লিখেছেন, আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি আবার অনেকগুলো শ্যামা সংগীত, ভজনও লিখেছেন। তিনি ১৯৩৭ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচনের ক্যাম্পেইন করার জন্য ফরিদপুর পর্যন্ত এসেছিলেন। ফরিদপুরের লোকজন ইসলামী জাগরণের কবিকে একদিন এক রাত পানিও খেতে দেননি। বলেছিল ‘এটা’ হিন্দু হয়ে গেছে। যেহেতু শ্যামা সংগীত লিখেছে, ভজন লিখেছে, অতএব সে আর মুসলমান নেই। আমি প্রেক্ষাপটটা বুঝার জন্য একথা বলছি। ব্রিটিশরা যখন ঔপনিবেশিক শাসন ছেড়ে চলে যাবে বা যেতে বাধ্য হচ্ছে তখনি আমাদের পূর্ব পুরুষরা এই ভূখণ্ডে বসবাসকারীদের একেবারে দুটো জাতিতে বিভক্ত করে। একটা হিন্দু, আরেকটা মুসলমান। এর সুযোগ নিয়ে ব্রিটিশরা তাদের চক্রান্ত অনুযায়ী পাকিস্তান এবং ভারত দুটো রাষ্ট্র তৈরি করে (Jalal, ১৯৮৫; Rashid, ২০১২)। আমাদের এলাকার লোকেরা অর্থাৎ এই পূর্ব-বাংলার লোকেরা পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্য ভোট দিয়েছিল। হিন্দুদের একটা রাষ্ট্র। মুসলমানদের আরেকটা রাষ্ট্র। যদিও এর মধ্যে কারসাজি ছিল। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মনে কখনই এরকম একটা সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র ভাবনা স্থান পায়নি, এটা তার মাথায় ছিল না। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বাঙালি জাতীয় চেতনাভিত্তিক বাংলাদেশই তাঁর কল্পনার রাষ্ট্র ছিল। তবে সে সময়ের বাস্তবতায় সাম্প্রদায়িক চেতনার বিপরীতে হঠাৎ করে একটা রেডিকেল কিছু করা বাস্তবসম্মত নয় বলেও মনে করতেন। যার কারণে আজকের যে আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বকারী দল, সেটা কিন্তু প্রথমে আওয়ামী লীগ ছিল না। আওয়ামী মুসলিম লীগ ছিল। ১৯৫৫ সালে বঙ্গবন্ধু অনেকটা একক কর্তৃত্ব ও সাংগঠনিক ক্ষমতায় আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দেন (ঘোষ, ২০০৯; খান, ২০১৪)। শুরুতেই যদি এই আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে মুসলিম বাদ দেয়া হতো তাহলে দলটি এভাবে এ পর্যায়ে আসতেই পারতো না। কারণ মানুষের মনমানসিকতা তখনও ঐভাবে তৈরি হয়নি। একটা সাম্প্রদায়িকভাব মানুষের মনে যে কোনো কারণেই হোক ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের শেষের দিকে এসে জোরালো হয় (অযসবফ, ১৯৭৫)। তারপরেও পাকিস্তান আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান এবং পাকিস্তান তৈরি হলো। প্রথম আঘাতটাই আসে আমাদের ভাষার উপরে। আমাদের ভাষা সম্পর্কে যখন আলোচনা হয় তখন ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন ও ২১ ফেব্রুয়ারির কথাই বলি, যার ফলে পরবর্তী পর্যায়ে রাষ্ট্র ভাষা স্বীকৃতি পেল বাংলা।

আরেকটা প্রচলিত বিশ্বাস, আমরা প্রায়ই বলি স্বাধীনতার জন্য সমগ্র জাতি ১৯৭১ সালে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলাম, এটাও আমি বিশ্বাস করি না। আসলে আমরা ঐক্যবদ্ধ হইনি। প্রথম প্রমাণ হচ্ছে ১৯৪৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানে মিটিং হয়েছিল এই যে নতুন পাকিস্তান রাষ্ট্রটা হলো এটার রাষ্ট্রভাষা কী হবে? সেখানে যত বাংলা ভাষাভাষী এমসিএ ছিল, কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ছাড়া সবাই বলেছিল উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা। পাকিস্তান নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল যে, এদেশে রবীন্দ্র সংগীত গাওয়া যাবে না। মাত্র ১০ জন বুদ্ধিজীবী এটার প্রতিবাদ করেছিল, এটা বড় অন্যায়। পরদিন পাকিস্তান সরকারের সিদ্ধান্তের পক্ষে বিবৃতি দিয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানের ১১০ জন বুদ্ধিজীবী। আমরা যে বলি সমগ্র জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলাম মুক্তিযুদ্ধে, এটা সঠিক বলি না। পরবর্তী পর্যায়ে ছয়দফা আন্দোলনের প্রথম দফাটি ছিল ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে। ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবে বলা হয়েছিল ভারতের উত্তর-পশ্চিম এবং পূর্বাঞ্চলে মুসলমানদের জন্য দুটি আলাদা রাষ্ট্র করা হবে (জধংযরফ, ২০১২)। আর এটাকে কেটে একটা রাষ্ট্র করা হলো। প্রত্যেকটা স্টেটকে স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে। সেটা ছিল ৬ দফা। ভারত ৬ দফা প্রণয়ন করে দিয়েছে এটা বলার বহু লোক এদেশে ছিল (খান, ২০১৮: ১৬৮-৬৯)। আর এই কারণে খোদ বাঙালির জননেতা শেখ মুজিবুর রহমান (১৯৬৬) ছয় দফার পক্ষে ‘আমাদের বাঁচার দাবি’ পুস্তিকায় জনগণের উদ্দেশ্যে বলেন –
“অতীতে পূর্ব পাকিস্তনবাসীর নিতান্ত সহজ ও ন্যায্য দাবি যখন উঠিয়াছে তখনই এই দালালরা এমনিভাবে হৈচৈ করিয়া উঠিয়াছে। আমাদের মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মুক্তির সনদ একুশ দফা দাবি, যুক্ত নির্বাচন প্রথার দাবি, ছাত্র তরুণদের সহজ ও স্বল্প ব্যয়ে শিক্ষালাভের মাধ্যম করার দাবি ইত্যাদি সকল প্রকার দাবির মধ্যেই এই শোষকের দল ও তাদের দালালরা ইসলাম ও পাকিস্তান ধ্বংসের ষড়যন্ত্র আবিষ্কার করেছেন। আমার প্রস্তাবিত ছয়দফা দাবিকেও তেমনিভাবে পাকিস্তানকে দুই টুকরা করবার দুরভিসন্ধি আরোপ করতেছেন।”
জামায়াতে ইসলামী শেখ মুজিবকে ভারতের ‘এজেন্ট’ আখ্যা দিয়ে ছয় দফা ভারতের প্রণীত বলে দাবি করে। বামপন্থী বিভিন্ন দল এমনকি ন্যাপ (ভাসানী) ছয় দফার সমালোচনা করেছে। ছয় দফার বিরুদ্ধে ন্যাপ-ভাসানী সবচেয়ে বেশি সোচ্চার ছিল। বাঙালিকে হতবাক করে দিয়ে মওলানা ভাসানীও ছয় দফাকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন (খান, ২০১৮: ১৬৯)। বস্তুত ৬ দফার মধ্যে সরাসরি স্বাধীনতার কোনো কথাও ছিল না। স্বায়ত্তশাসনের কথা ছিল। ১৯৭০-এর নির্বাচনে পূর্ব-পাকিস্তানে ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন আওয়ামী লীগ পেয়ে যায়। তবে ভোটের হিসাবটা ভিন্ন। জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ভোট পেয়েছিল ৭২. ৫৭ শতাংশ (Maniruzzaman,, ২০০৯: ৬৯)। নির্বাচনী এই ফলাফলের আরেক অর্থ হলো ৬ দফার বিপক্ষে ভোট দিয়েছিল ২৭.৪৩% বাঙালি। তার অর্থ দাঁড়াচ্ছে এই দেশের এক-চতুর্থাংশেরও বেশি লোক স্বাধীনতা তো দূরের কথা, ৬ দফারও বিরুদ্ধে ছিল। অতএব আমরা সমগ্র জাতি মিলে যুদ্ধ করেছি এটা সঠিক বলি না। এই ২৭.৪৩% শতাংশ লোক মুক্তিযুদ্ধের সময় যাদেরকে আমরা বলি আলবদর, রাজাকার, যুদ্ধাপরাধী, আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং হত্যা, রাহাজানি, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ এসমস্ত কাজে তারা অংশগ্রহণ করে; পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সহায়তা করে। এ কথাগুলো বলছি এজন্য যে, শত্রু চিহ্নিত হওয়া প্রয়োজন। এরা ছিল আমাদের অভ্যন্তরীণ শত্রু । আন্তর্জাতিকভাবে গুটিকয়েক দেশ ছাড়া সারা পৃথিবী আমাদের বিপক্ষে ছিল (Sisson and Rose, ১৯৯০)। আমাদের আজকের বন্ধু চীন, আমাদের যত লোক নিহত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধে, ৩০ লক্ষ শহীদ হয়েছেন, এর অধিকাংশ লোককে চাইনিজ রাইফেলের গুলিতে হত্যা করা হয়েছে। কারণ চীন ছিল পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় বন্ধু। আমেরিকারও একই অবস্থা। সৌদি আরবের বাদশাসহ সবাই এদেশে হত্যা, ধর্ষণ ও লুণ্ঠনকে সমর্থন করেছিল (Shelly, ২০০৭)। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমাদের দেশ বিজয় লাভ করার মাত্র ৯ দিন আগের ঘটনা, ৭ ডিসেম্বর নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাংলাদেশের পক্ষে-বিপক্ষে ভোটাভুটিতে ১১০টা দেশ আমাদের বিপক্ষে ভোট দিয়েছিল (হাসান, ২০০৯)। আমি শত্রু চিহ্নিত করছি শুধু দেশের স্বার্থে। সৌদি আরব আমাদের স্বীকৃতি দেয় ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট সন্ধ্যায়। প্রথমে নিশ্চিত হয় যে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর দাফন কাফন সম্পন্ন হয়েছে, এর পরেই আমাদের স্বীকৃতি দেয়। বিদেশি শত্রু যারা ছিল তাদের আবার শাখা-প্রশাখা ছিল দেশের ভিতরে। যাদের আমরা বলি মার্কসবাদী-লেনিনবাদী। ১৯৬০ ও ৭০-এর দশকে যাদের পৃথিবীব্যাপী প্রভাব ছিল। এদের বিভিন্ন সংঘবদ্ধ দল যেমন, পূর্ববাংলার কম্যুনিস্ট পার্টি, সর্বহারা পার্টি। প্রত্যেকটা দল অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে ছিল এবং কোথাও কোথাও তারা মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। নোয়াখালীতে মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করার জন্য এই সংঘবদ্ধ দলগুলো সক্রিয় ছিল। এই যে ত্রিপক্ষীয় শক্তি, দেশের অভ্যন্তরীণ দালাল, বিদেশি শক্তি এবং তাদের দালালরা সবাই আমাদের অগ্রসর চিন্তার বিপক্ষে ছিল। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ একদিকে সেনাবাহিনীর একটা দল চলে গেল শেখ মনির বাড়িতে, এক গ্রুপ চলে গেল আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের বাড়িতে, অন্যদল চলে গেল ৩২ নম্বরে, একটা দল চলে এলো রেডিওতে (জামিল, ১৯৯৮)। রেডিওতে যারা এলো তারা এসেই স্বাধীনতার স্লোগান ‘জয় বাংলা’-কে নির্বাসিত করে পাকিস্তানি কায়দায় বাংলাদেশ জিন্দাবাদ ঘোষণা করে, বাংলাদেশ বেতার হয়ে গেল রেডিও বাংলাদেশ। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কেবলমাত্র রাষ্ট্র ক্ষমতা বদল করার একটা অভ্যুত্থান ছিল না। তখন বিভিন্ন দেশে প্রায়ই অভ্যুত্থান হতো, এই অভ্যুত্থ্যানের কারণ ছিল রাষ্ট্র ক্ষমতা বদল করা। সকালে একজন, বিকেল বেলা আরেকজন। তখন কমন একটা ব্যাপার ছিল ক্ষমতা দখল। পুরা বিশ্ব কোল্ড ওয়ারের আওতায় ছিল। রাশিয়ান বলয়, আমেরিকান বলয়। পাল্টাপাল্টি এগুলো ছিল। ১৯৭৫ সালের অভ্যুত্থান, এটা এরকম ক্ষমতা দখল করার একটা অভ্যুত্থান ছিল না। একদল সেনাবাহিনীর থেকে আরেক দল সেনাবাহিনীর জেনারেল ক্ষমতা নেয়ার অভ্যুত্থান নয়। পুরো রাষ্ট্রটাকে বদল করার অভ্যুত্থান ছিল সেটা।

১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ৬৬-এর ছয় দফা আন্দোলন, ৭০-এর নির্বাচন সব কিছুকে নিয়ে ৭১-এ যখন মহান মুক্তিযুদ্ধ, ৩০ লক্ষ লোকের রক্তের বিনিময়ে যে স্বাধীন রাষ্ট্রটা তৈরি করলাম, এটাকে পূর্ব পাকিস্তানে পরিণত করা হয়। অর্থাৎ পাকিস্তান রাষ্ট্রের যত অনুষঙ্গ ছিল, সব ফিরে এলো। একজনের পর একজন জেনারেল আসলো, আমাদের পুরো গণতন্ত্রকে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে বন্দি করা হলো। আমরা ক্যান্টনমেন্টে অবরুদ্ধ ছিলাম ২০-২২ বছর। আমাদের প্রেসিডেন্ট ক্যান্টনমেন্টে ছিল, তথাকথিত হাঁ/না ভোটের মাধ্যমেই বৈধতা কেড়েছিল। তথাকথিত নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ক্যান্টনমেন্টে থেকেই নির্বাচিত হতো। এরপরে আমাদের প্রধানমন্ত্রীও ক্যান্টনমেন্টে থাকতো। আমাদের বিরোধীদলীয় নেত্রী ক্যান্টনমেন্টে থাকতো। প্রেসিডেন্ট বদল হলো, ‘শর্ষিনা-সানগ্লাস-সাফারি’ থেকে ‘আটরশি-হেলিকপ্টার-মেরীর’ দিকে চলে গেল। জেনারেল শুধু বদল হলো। একই বলয়ের মধ্যে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, আমাদের সার্বভৌমত্ব আটকা পড়ল। আমাদের যা কিছু আছে অর্থাৎ বাঙালির যা কিছু ছিল সবটাই ক্যান্টনমেন্টে বন্দি করা হলো। আমি তো মনে করি বঙ্গবন্ধু আমাদের এই দেশটা স্বাধীন করে দিয়ে গেছেন, ১৯৭৫’র পর সে রাষ্ট্রটি ছিল না। এটা কেবল পুনরুদ্ধার করা হয় ১৯৯৬ সালে, পাকিস্তান থেকে আবার বাংলাদেশ। যে দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু স্বাধীন রাষ্ট্র চেয়েছিলেন, সেটার পুনঃজন্ম হয়। আমরা এখন একটা উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। এখানে যেরকম ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলা হয় তা হলো সকলের ধর্মীয় স্বাধীনতা। আমরা যে গণতন্ত্রের কথা বলি, সেটা বঙ্গবন্ধুর গণতন্ত্রের কথা। গণতন্ত্রের একটা সংজ্ঞা আছে যেটা আব্রাহাম লিংকন দিয়ে গেছেন। বঙ্গবন্ধুর গণতন্ত্রের সংজ্ঞা যদি নেন তাহলে কিন্তু গণতন্ত্রের ভিতরে যে সমস্যাগুলো রয়েছে সেগুলো চিহ্নিত করা যাবে। গণতন্ত্রই সর্বোৎকৃষ্ট ব্যবস্থা এটা বলা যাবে না। এরচেয়ে ভালো ব্যবস্থা আর নেই বলেই আমরা বলি এটাই সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যবস্থা। গণতন্ত্র বলতেই বুঝানো হয় সবাই যেটা বলবে অথবা মেজোরিটি লোক যেটা বলবে এটাই মেনে নেওয়া। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণের মধ্যে বঙ্গবন্ধু বলে গেছেন, একজনও যদি ন্যায্য কথা বলেন সেটা মেনে নেয়াই হচ্ছে গণতন্ত্র। বঙ্গবন্ধুর ভাষায় “…যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও একজন যদিও সে হয় তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব।” তাহলে গণতন্ত্রের সংজ্ঞাটা কি হওয়া উচিত? গণতন্ত্র বলতে বঙ্গবন্ধু কি বুঝালেন? আমরা সনাতনভাবে গণতন্ত্র বলতে যা বুঝি, সবাই মিলে বা বেশিরভাগ লোকে যা ভালো বুঝি, সেটাই গণতন্ত্র। পৃথিবীতে এমন অনেক ঘটনা আছে সবাই মিলে ভুল করছে। অধিকাংশ লোক বা সব লোক যেটা বলছে সেটাই সত্য? মানুষের মধ্যে সবাই মিলে যা বলে এটাকে সত্য হিসেবে ধরে নেওয়ার একটা প্রবণতা আদিকাল থেকে ছিল। সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে এটি তো কিতাবেও লেখা ছিল। সবাই যেহেতু এটা বলছে আর সবাই যেহেতু এটা লিখছে আর কিতাবে যেহেতু আছে সেটাই সবাই বিশ্বাস করছে। আসল সত্যটা হচ্ছে, সূর্য স্থির আছে, পৃথিবীই সূর্যের চারদিকে ঘুরছে। এটা বলতে গিয়ে অনেকের জীবন চলে গেছে। অতএব গণতন্ত্র বলতে সবাই যেটা বুঝে এটা গণতন্ত্র না। অথবা বেশির ভাগ মানুষ যা বোঝে সেটা গণতন্ত্র না, যেটা ন্যায্য কথা, যেটি সত্য কথা সেটাই গণতন্ত্র। সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী বিল গৃহীত হওয়ার পরদিন বঙ্গবন্ধু জাতীয় সংসদে ভাষণে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন :

“আমি চাই শোষিতের গণতন্ত্র, শোষকের নয়। এখনো মানুষ না খেয়ে কষ্ট পাচ্ছে। যে মানুষের কাপড় নাই, যে মানুষ বন্ধু খুঁজে পায় না, যার বুকের হাড্ডি পর্যন্ত দেখা যায়, আমি জীবনভর এদের সঙ্গে থেকে সংগ্রাম করেছি। এদের পাশাপাশি রয়েছি। কারা নির্যাতন ভোগ করেছি। আমার সহকর্মীরা জীবন দিয়েছে। তাদের দুঃখ দূর করার জন্য আমি একদিন এই হাউজে বলেছি, আমরা শোষিতের গণতন্ত্র চাই [ … ] যারা রাতের অন্ধকারে পয়সা লুট করে, যারা বড় বড় অর্থশালী লোক, যারা ভোট কেনার জন্য পয়সা পায় তাদের গণতন্ত্র নয়, শোষিতের গণতন্ত্র। এটা আজকের কথা নয়, বহুদিনের কথা আমাদের।”
আমাদের জাতীয় পরিচয়টা কি হবে, আমরা এটা নিয়েও অনেক সময় বিতর্কে জড়িয়ে পড়ি। আমরা বাঙালি ছিলাম তারপরেও তো আমাদের বাংলাদেশি করে দেওয়া হলো। জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে আমাদের যে সংবিধান, জাতির জনক ১৯৭২ সালে আমাদের উপহার দিয়েছিলেন, সে সংবিধান একটা স্তম্ভ হচ্ছে জাতীয়তাবাদ। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি রেসকোর্সে যে ভাষণ দিয়েছিলেন “আমি বাঙালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান” এই তিনটি পরিচয় অর্থাৎ বাঙালি, মুসলমান, মানুষ এর সংমিশ্রণটা আমরা পেয়েছি। একটা কথা বলতে চাই, আমরা যে মুসলমান এটার সাথে মরুভ‚মির মুসলমানের পার্থক্য আছে। মুসলমান হয়েছি আমরা বেশিদিন হয়নি, ১২০৫ সালে এই এলাকায় উল্লেখ করার মতো মুসলমান ছিল না (কযধহ, ১৯৯৬)। আরব ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সম্পর্কের কারণে চট্টগ্রাম অঞ্চলে অল্পকিছু মুসলমান ছিল। মূল বাংলাদেশে কোনো মুসলমান ছিল না।
তার আগেও তো আমরা মানুষ ছিলাম, ১২০৫ সালের আগে আমরা বাঙালি ছিলাম। যে সকল কারণে আমরা ফরাসি না, জার্মান না, চাইনিজ না, এজন্য আমরা বাঙালি। আমরা যেভাবে আছি, যেভাবে খাই, যেভাবে চলাফেরা করি, আমাদের পোশাক-আশাক যেটা দিয়ে বুঝা যায় আমি একজন চাইনিজ না, আমি একজন ফরাসি না, আমি ইংরেজ না, এজন্য আমি বাঙালি। আমাদের বিশ্বাস, আমাদের সামাজিকতা, আমাদের মূল্যবোধ, আমাদের গান, আমাদের নাটক, নৃত্য, সাহিত্য, উৎসব এই সবকিছু মিলেই আমরা অন্যদের থেকে একটু আলাদা (মুরশিদ, ২০১২)। আমাদের দেশে যখন ইসলাম আসে, বড় বড় ওলামা সাহেবরা এখন যেভাবে ইসলাম নিয়ে কথা বলেন তাদের মতো ওলামারা তখন আসেননি। যারা ইসলাম নিয়ে এসেছিলেন তারা ছিলেন সুফি, সাধক শাহজালাল, বায়েজিদ বোস্তামি, খানজাহান আলী প্রমুখ (অযসবফ, ১৯৮১)। আমরা যাদের অলি বলি এই টাইপের লোকজন ছিলেন। তাঁরা আমাদের বলেছিলেন আল্লাহ এক, নামাজ পড়, চুরি করো না, মিথ্যা বলো না এর চেয়ে বেশি কথা বলেননি। বলেছেন, তোমরা যেভাবে আছো সেভাবে থাকো। বাঙালির মধ্যে যা আছে তা নিয়েই থাকো। ইসলাম এতো দ্রুত একসেপটেড হলো কীভাবে? মাঝখানে ১০০০-১৫০০ মাইল দূরত্বে কেন এরকম হলো? এই এলাকার লোকজনদের ধর্ম প্রচারকরা বাঙালি সংস্কৃতি যেটা ছিল এর সাথে মিশ্রণ করার জন্য ইসলামের কতগুলো আদি ও অকৃত্রিম কথা বললেন। সেগুলোর সাথে এই বাঙালিত্বের অনুষঙ্গগুলো অব্যাহত রাখতে বললেন। এগুলোকে পাল্টাপাল্টি করে দাঁড় করাননি। তাঁরা বলেছিলেন তুমি যেভাবে বাঙালি আছো এভাবেই থাকো, যার কারণে দ্রুত ইসলামের প্রসার ঘটেছে। আর এখন যেভাবে ইসলামের কথা বলে “হুজুর’রা” যদি এইভাবে ইসলামে নিয়ে আসতো তাহলে আর ইসলাম কায়েম হতো না। প্রত্যেক মানুষেরই একটা ধর্ম আছে। যার ধর্ম বিশ্বাস নাই, সেটাই তার ধর্ম। বাঙালির সংস্কৃতি ও মানবিকতা মিশিয়ে আমাদের জাতির জনক বলেছিলেন বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা। যেটা দিয়ে আমি অন্যদের থেকে আলাদা হবো। কিন্তু ধর্মের মধ্যে যে মরু সংস্কৃতি ছিল সেটা পুরোটাই চলে আসছে। মরুভ‚মি থেকে ডলার আসছে, ডলারের সাথে সাথে চিন্তার মরুকরণ, ওখানকার কালচার, পোশাক, লেবাস, অবয়বে পরিবর্তন সব কিছুই আসছে। আজ যেটাকে মরু কালচার বলছি ষাট-সত্তরের দশকেও এরকম ছিল না। সত্তরের দশকে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম তখন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের পোশাক-আশাক, চেহারায় এত মরুকরণ ছিল না। এখন মরুকরণ ব্যাপক হারে বাড়ছে। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক চিন্তার একটি অন্যতম ভিত্তি হলো অসাম্প্রদায়িক চিন্তা। বাংলাদেশ রাষ্ট্রেরও অন্যতম দার্শনিক ভিত্তি এটি। অসাম্প্রদায়িক চিন্তা আর বাঙালি জাতীয়তাবাদ একই সূত্রে গাথা। এর বিপরীতে রয়েছে বিএনপি-জামায়াতের ধর্মাশ্রয়ী বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ (নাগরিকত্ব অর্থে নয়, চেতনাগত অর্থে)। এটি সত্য, বঙ্গবন্ধু তরুণ বয়সে মুসলিম লীগের একজন সক্রিয় কর্মী হিসেবে পাকিস্তান আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন। জনসাধারণের দুঃখ লাঘব করতে তখন তিনি দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের জন্য লঙ্গরখানা খুলে কাজ করেছেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর দেশে খাদ্যের অভাব দেখা দিলে, তিনি সুষম খাদ্য বণ্টনের আন্দোলন, ভুখা মানুষের মিছিলে অংশগ্রহণ করেন। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধে কাজ করেন। ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট কলকাতায় মুসলিম লীগের প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসকে কেন্দ্র করে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। তরুণ মুজিব ছুটে বেড়ান দাঙ্গাকবলিত মুসলিম, হিন্দু দুই জনগোষ্ঠীকেই উদ্ধার করতে। বঙ্গবন্ধুর ভাষায় : “দু-এক জায়গায় উদ্ধার করতে যেয়ে আক্রান্তও হয়েছিলাম। আমরা হিন্দুদের উদ্ধার করে হিন্দু মহল্লায় পাঠাতে সাহায্য করেছি। মনে হয়েছে, মানুষ তার মানবতা হারিয়ে পশুতে পরিণত হয়েছে (রহমান, ২০১২: পৃ. ৬৬)।” কলকাতায় তিনি হিন্দু, মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের লোককেই উদ্ধারের চেষ্টা করেন। সা¤প্রদায়িক স¤প্রীতি ফিরিয়ে আনার জন্য মহাত্মা গান্ধীর দ্বারস্থ হয়েছিলেন সোহরাওয়ার্দী। সোহরাওয়ার্দীর সেই প্রচেষ্টায় তখন বঙ্গবন্ধুও যুক্ত হন। পাকিস্তান আন্দোলনে যুক্ত হলেও বঙ্গবন্ধু রাজনৈতিক জীবনের প্রথম থেকেই সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন।
বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে সুসংহত করেছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনা ছড়িয়েই। আবুল মনসুর আহমেদ, আতাউর রহমান খান মুসলিম বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে ‘মুসলিম বাংলা’ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। অসংখ্য কমিউনিস্ট নেতাদের আমরা সেই মতাদর্শিক বিষয়ে কলম ধরতে দেখেছি (আহাদ, ১৯৮৪)। কিন্তু বঙ্গবন্ধু পূর্ব-বাংলায় হিন্দু-মুসলিম বিভেদে রাজি ছিলেন না। তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম বাঙালির সমর্থন পেতে কখনো হিন্দু বাঙালির বিরুদ্ধে ঘৃণা সৃষ্টি ও সংঘাতের রাজনীতি করেননি। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি শোষকদের হাত থেকে বাঙালির মুক্তি আন্দোলনে হিন্দু-মুসলিম দুই সম্প্রদায়কে যুক্ত করেন। বাঙালির ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুই প্রথম এবং সম্ভবত একমাত্র সফল নেতা যিনি হিন্দু-মুসলিম দুই সম্প্রদায়কে একত্রিত করেছেন (খান, ২০১৪)। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী বা স্বরাজ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে মুসলিমদের সমর্থন ছিল না, আবার উচ্চ বর্ণের হিন্দু নেতারাও মুসলিমদের এইসব জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে যুক্ত হননি। বঙ্গবন্ধু এমনকি বাঙালিদের অন্য কোনো জাতির বিরুদ্ধে, যেমন বিহারিদের বিরুদ্ধে, সহিংস আচরণে প্ররোচনা দেননি। বরং তাদের নিরাপত্তা দিতে ৭ মার্চের ভাষণে আওয়ামী লীগ কর্মীদের নির্দেশ দিয়েছেন। “এই বাংলায় হিন্দু-মুসলিম, বাঙালি, অ-বাঙালি যারা আছে তারা আমাদের ভাই, তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের উপর, আমাদের যেন বদনাম না হয়।” তিনি সকল জনগোষ্ঠীর সহাবস্থান এবং সব নাগরিকের সমান অধিকারে বিশ্বাস করতেন।
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনে সাম্যের কথাটা এসেছিল সমাজতন্ত্র হিসেবে। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন পুঁজিবাদী অর্থনীতি দর্শনগতভাবেই মানুষে মানুষে বিভেদ উদ্রেককারী। আর এইজন্য অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু বলছেন :
“আমি নিজে কমিউনিস্ট নই, তবে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি এবং পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে বিশ্বাস করি না। একে আমি শোষণের যন্ত্র হিসাবে মনে করি। এই পুঁজিপতি সৃষ্টির অর্থনীতি যত দিন দুনিয়ায় থাকবে, তত দিন দুনিয়ার মানুষের উপর থেকে শোষণ বন্ধ হতে পারে না। পুঁজিপতিরা নিজেদের স্বার্থে বিশ্বযুদ্ধ লাগাতে বদ্ধপরিকর। নতুন স্বাধীনতাপ্রাপ্ত জনগণের কর্তব্য বিশ্ব শান্তির জন্য সংঘবদ্ধভাবে চেষ্টা করা। যুগ যুগ ধরে পরাধীনতার শৃঙ্খলে যারা আবদ্ধ ছিল, সাম্রজ্যবাদী শক্তি যাদের সর্বস্ব লুট করেছে তাদের প্রয়োজন নিজের দেশকে গড়া ও জনগণের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক মুক্তির দিকে সর্বশক্তি নিয়োগ করা (রহমান, ২০১২: পৃ. ২৩৪)।”
বঙ্গবন্ধু দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন, শোষণমুক্তি এবং বৈষম্য দূরীকরণে সরকারের দায়িত্ব রয়েছে। চীনে গিয়ে তাঁর এই বিশ্বাস আরো দৃঢ় হয়। তিনি দেখতে পান, কীভাবে চীনে সামন্ততান্ত্রিক ভ‚মি মালিকানা পরিবর্তিত হয়েছে, ভ‚মিহীন কৃষক জমির মালিক হয়েছে “আজ চীন দেশ কৃষক-মজুরের দেশ। শোষক শ্রেণি শেষ হয়ে গেছে।” নতুন নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে রাষ্ট্র কিভাবে ছেলেমেয়েদের শিক্ষাপ্রাপ্তির মৌলিক চাহিদার ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করেছে (পৃ. ২৩০)। অনেক স্বপ্নই আমরা এখন দেখি, বঙ্গবন্ধু এতো স্বপ্ন দেখেননি। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল মিলেমিশে বাংলাদেশ ধনী-গরিব, পুরুষ-মহিলা, হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সবাই মিলে সাম্যের বাংলাদেশ। সবাই মিলেমিশে থাকবো। আমরা অনেক উন্নতি করলাম। আমাদের জিডিপি’র প্রবৃদ্ধি ৮%। জাতির জনকের যে বৈষম্যহীন বাংলাদেশ, সাম্যের বাংলাদেশ সেটা কোথায়। বৈষম্য দিন দিন বাড়ছে যেখানে একপর্যায়ে অরাজকতা সৃষ্টি হতে পারে, কয়েক বছর যাবৎ গিনি সহগে আমরা দশমিক ৫-এর সামান্য থেকে নিচে আছি। অরাজকতার বা চরম বৈষম্যের মাত্রা দশমিক ৫-এর বেশি দূরে নেই। বৈষম্যের কারণে অর্থনীতিতে একটা অরাজকতা তৈরি হয় সেটাও আমাদের মনে রাখতে হবে। ক্যাসিনোতে দেখলাম যারা নিঃস্ব হয়ে যায় তাদের ক্যাসিনোর মালিকরা খাওয়ার ব্যবস্থা করেন। আমরাও যদি এরকম ধনী হয়ে গেলাম, ধনী হতে গিয়ে সব ক্যাসিনোর হাতে চলে গেল, আমরা কেবল খেয়ে বেঁচে থাকলাম। আমার মনে হয় না যে জাতির জনকের স্বপ্নের সোনার বাংলা এটা ছিল। আর আমরা বলছি যে আয় বাড়ছে, বলছি ডলারের হিসাবে মধ্যম আয়ের দেশ, উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ ইত্যাদি। ইরাক, সিরিয়া, মিসর, অনেক আগেই ডলারের হিসাবে মধ্যম আয়ের দেশ ছিল। কিন্তু সেই দেশগুলো সেভাবে টিকে নেই। না টেকার কারণ হচ্ছে মতাদর্শগত দ্বন্দ্ব বা দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির অভাব। যে স্বপ্ন নিয়ে জাতির জনক স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন, যেই স্বপ্ন নিয়ে আমরা বাংলাদেশ করলাম যেটাকে বলি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। সেই চেতনা থেকেই যদি দূরে সরে যাই সেটা দিয়ে হয়তো উন্নয়ন হবে কিন্তু টেকসই হবে না। যেটা ইরাক, সিরিয়া, মিসরের ক্ষেত্রে হয়েছে। অতএব আমি আবারও বলছি জাতির জনকের স্বপ্নের সোনার বাংলা বলতে কেবল ধনী বাংলাদেশ না। যে দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে জাতির জনক একটা স্বাধীন সার্বভৌম আলাদা স্বতন্ত্র রাষ্ট্র সৃষ্টি করলেন, সেটা ছিল সাম্যের বাংলাদেশ, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ, মানুষে মানুষে ভালোবাসার বাংলাদেশ। সেখান থেকে কোনোভাবে আমাদের বিচ্ছিন্ন হওয়া যাবে না এবং সেটাই আমাদের অর্জন করতে হবে। দেশের শত্রু রা যারা একেবারে ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলন থেকেই সব কিছুর বিরোধিতা করে আসছে, তারা কখনোই নিষ্ক্রিয় হয় না। মাঝেমধ্যে দুর্বল হয়, এখানে সেখানে লুকায়, কিন্তু মনে রাখতে হবে এই অপশক্তি কখনই নিঃশেষ হয় না। নিঃসন্দেহে বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধই সর্বশ্রেষ্ঠ ঘটনা। বাঙালি জাতি তার দীর্ঘদিনের চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে নিজেদের জন্য একটি জাতি রাষ্ট্র গঠন করেছে। কিন্তু বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভিত্তি কী হবে? ১৯৭০ ও ৮০’র দশকে জেনারেলরা ট্যাঙ্কের বলে সংবিধান ইচ্ছামতো স্থগিত করেছে, সংশোধন করেছে। বাংলাদেশকে বানিয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান। বাংলাদেশকে উন্মুক্ত করে দিয়েছে প্রতিক্রিয়াশীল মৌলবাদী গোষ্ঠীর কাছে, যারা বাংলাদেশের জন্ম এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা দুটোই অস্বীকার করে। দেশের ও আশপাশের মৌলবাদী আগ্রাসন রোধে এবং নিকৃষ্টতম চলমান লুণ্ঠন ও দুর্নীতি, ক্রমবর্ধমান বৈষম্য দূর করে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের রাষ্ট্র গড়তে আমাদের বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক চিন্তাধারার কাছে ফিরতে হবে; বাংলাদেশকে তার দার্শনিক ভিত্তি বাঙালিত্ব, অসাম্প্রদায়িকতা, সাম্য ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজকে রাষ্ট্রীয় নীতির কেন্দ্রে নিয়ে আসতে হবে।

লেখক – উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *