মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০২:৩৪ অপরাহ্ন

হাতিরঝিলে ছেঁড়া কাগজের সূত্র ধরে ক্লুলেস হত্যাকান্ডের রহস্য উদঘাটন

বর্তমানকণ্ঠ ডটকম / ৫২ পাঠক
মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০২:৩৪ অপরাহ্ন

বর্তমানকন্ঠ ডটকম, ঢাকা : হাত পা রশি দিয়ে বাধা অজ্ঞাত এক যুবকের লাশ, পুরো শরীর ছিল বেডশীট-মশারি ও পলিথিন দিয়ে মোড়ানো। ফিঙ্গারপ্রিন্টের মাধ্যমে লাশের পরিচয় যাতে সনাক্ত করা না যায় সেজন্য হাতের আঙ্গুল বিকৃতকরনের পাশাপাশি মুখমন্ডলও বিকৃত করে হত্যাকারীরা। এমন একটি অজ্ঞাতনামা যুবকের অর্ধগলিত লাশ গত ১২ অক্টোবর, ২০২০ সকাল সাত টায় হাতিরঝিল লেকের মেরুল-বাড্ডা প্রান্ত থেকে উদ্ধার করে হাতিরঝিল থানা পুলিশ। সূত্র – ডিএমপি।

হত্যা সম্পর্কিত কোন একটি ক্লুর খোঁজে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে মৃতদেহের চারপাশ খুঁজতে থাকে হাতিরঝিল থানা পুলিশ। লেকের যে স্থানে এ মৃতদেহটি ভেসে ছিল সেখান থেকে প্রায় ৫০ মিটার উত্তরে একটি ছেড়া কাগজ পায় পুলিশ। ছেড়া কাগজে লেখা একটি মোবাইল নম্বরের সূত্র ধরে মৃত ব্যক্তির পরিচয় সনাক্তের পাশাপাশি হত্যাকান্ডে জড়িত আসামীদের গ্রেফতার করতে সক্ষম হয় হাতিরঝিল থানা পুলিশ।

১৩ অক্টোবর, ২০২০ তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল জোনের এডিসি হাফিজ আল ফারুক এর নেতৃত্বে, এসি আশিক হাসানসহ একটি টীম রাত ০১.২০ টা থেকে ভোর ০৬.৪০ টা পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে খিলক্ষেত থানার উত্তরপাড়া এলাকা থেকে আহসান ও তামিম, হাতিরঝিল থানাধীন মহানগর আবাসিক এলাকা থেকে আলাউদ্দিন এবং রামপুরা এলাকা থেকে রহিমকে গ্রেফতার করে।

গ্রেফতারের পর অজ্ঞাত মৃতব্যক্তির পরিচয় হত্যাকান্ড সম্পর্কে তারা বলে, মৃত ব্যক্তির নাম আজিজুল ইসলাম মেহেদী। বয়স ২৪ বছর। তিনি আন্তর্জাতিক ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামের ইংরেজি বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র ছিলেন। লেখাপাড়ার পাশাপাশি পরিচিতজনদের পাসপোর্ট ও ভিসা প্রসেসিংয়ে সহায়তা করতেন মেহেদী।

গ্রেফতারকৃত আহসান নিহত আজিজুল ইসলামের বাল্যবন্ধু। সে গুলশানের একটি রেস্টুরেন্টে এক্সিকিউটিভ শেফ হিসেবে চাকরি করতো। করোনায় রেস্টুরেন্ট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আর্থিক সংকটে পড়ে আহসান। তখন সে আলাউদ্দিনের কাছে কিছু টাকা ধার চায়। আলাউদ্দিন পেশায় ড্রাইভার হলেও পাসপোর্ট অফিসে দালালী ও পরিবহন পুলের পুরাতন গাড়ি ক্রয়-বিক্রয়ের সাথে জড়িত ছিল। আলাউদ্দিন আহসানকে টাকা ধার না দিয়ে পাসপোর্ট সংক্রান্ত কাজ (নামের বানান সংশোধন, জন্ম তারিখ সংশোধন, বয়স বাড়ানো কমানো) দিতে বলে। এ কাজে যে টাকা পাওয়া যাবে তা দুজনে ভাগ করে নিবে।

আহসান বাল্যবন্ধু আজিজুল ইসলাম মেহেদীকে জানায় পাসপোর্টে সমস্যা সংক্রান্ত কোন কাজ থাকলে সে সমাধান করে দিতে পারবে।

চট্টগ্রামের তিনটি পাসপোর্টের নাম ও বয়স সংশোধনের জন্য ১২ আগষ্ট, ২০২০ এ ঢাকায় আহসানের কাছে আসে মেহেদী। দুই সপ্তাহের মধ্যে পাসপোর্টের তিনটির নাম ও বয়স সংশোধন করে দেওয়ার বিনিময়ে আলাউদ্দিনকে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা ও আহসানকে ১ লাখ টাকা দেয় মেহেদী।

নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পাসপোর্ট সংশোধন করতে না পারায় ভিকটিম মেহেদী তাদেরকে চাপ দিলে তারা এক সপ্তাহ সময় চেয়ে নেয়। এই সময়েও পাসপোর্ট সংশোধনের কাজ করতে না পারায় পাসপোর্ট ও টাকা ফেরত চায় মেহেদী। এতে তারা টাকা ফেরত না দিয়ে সময় ক্ষেপন করতে থাকে। একপর্যায়ে মেহেদী তাদের জানায় পাসপোর্ট ও টাকা ফেরত না দিলে ঢাকায় এসে তাদের অফিসে অভিযোগ করবে। চাকরি হারানোর ভয়ে আহসান ও আলাউদ্দিন মেহেদীকে হত্যা করার পরিকল্পনা করে। এ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আহসান ও আলাউদ্দিন পাসপোর্ট নেওয়ার জন্য মেহেদীকে ১০ অক্টোবর ঢাকায় আসতে বলে।

১০ অক্টোবর রাত ১১.১০ টায় চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসে পৌঁছে মেহেদী। হত্যাকান্ডের পরিকল্পনা মোতাবেক আহসান মেহেদীকে খিলক্ষেত উত্তরপাড়ায় অবস্থিত তার ভাড়া বাসায় নিয়ে যায়। খাবারের সাথে ঘুমের ঔষধ খাওয়ানো হয় মেহেদীকে। ব্যক্তিগত কাজের কথা বলে বাসার বাহিরে চলে যায় আহসান। রাত অনুমান ০১.৩০ টার দিকে ঘুমন্ত মেহেদীকে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করে হাত, পা রশি দিয়ে শক্ত করে বেধে বেডশীট, মশারি ও পলিথিনে মুড়িয়ে ফেলে আলাউদ্দিন। এরপর সে আহসানকে মোবাইল ফোনে হত্যার বিষয়টি কনফার্ম করে ।

আহসানের পাশের রুমের ভাড়াটিয়া তামিম (রেষ্টুরেন্টে কর্মরত কলিগ) আকস্মিকভাবে আহসানের রুমে ঢুকে হত্যাকান্ডের বিষয়টি জানতে পারে। আহসানের অনুরোধের তামিম বিষয়টি কাউকে বলবে না এবং লাশটি সুবিধাজনক স্থানে ফেলে দিতে আহসানকে সহায়তা করবে বলে জানায়।

সেইরাতে লাশ সরাতে না পেরে বিছানার নিচে রেখে দুপুর বারোটার দিকে রেষ্টুরেন্টে ডিউটিতে যায় আহসান ও তামিম। কাজ শেষে দুজন একসাথে বাসায় ফেরে। রাত একটার দিকে আলাউদ্দিনের নির্দেশে ড্রাইভার রহিম আলাউদ্দিনের নোয়া মাইক্রোবাসটি চালিয়ে লাশ গুম করতে আহসানের বাসায় যায়।

আহসান ও তামিম মেহেদীর লাশটি মাইক্রোবাসে উঠিয়ে হাতিরঝিল এলাকায় প্রবেশ করে। পথে তামিম নেমে যায়। হাতিরঝিল লেকের মেরুল-বাড্ডা প্রান্তে লোকজন বিহীন ও অন্ধকারচ্ছন্ন দেখে ড্রাইভার রহিম গাড়ি থামিয়ে দরজা খুলে দেয়। আহসান লাশটি গাড়ি থেকে পানিতে ফেলে দেয়।

গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে তিনটি পাসপোর্ট ও চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসার জন্য ব্যবহৃত মেহেদীর বাস টিকিট জব্দ করা হয়েছে। পাশাপাশি যে মাইক্রোবাসটি ব্যবহার করে মেহেদীর লাশ হাতিরঝিলে ফেলে দেওয়া হয়েছে, সেই মাইক্রোবাসটিও জব্দ করা হয়েছে।

গ্রেফতারকৃত আহসান, আলাউদ্দিন ও রহিম বিজ্ঞ আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে।

এ বিষয়ে তেজগাঁও বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বিপিএম (বার), পিপিএম (বার) জানান- ‘এটি একটি ক্লু-লেস হত্যাকান্ড। একটি ছেড়া কাগজে লেখা একটি মোবাইল নম্বরের সূত্র ধরে লাশের পরিচয় সনাক্তকরনের পাশাপাশি হত্যাকান্ডে জড়িত চারজন আসামীকে গ্রেফতার ও সব আলামত উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছি আমরা। পুলিশি তদন্তের উৎকর্ষতার প্রমান এই মামলাটি’।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *