শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৮:১৮ পূর্বাহ্ন
বাকিউল্লাহ রিপন, বর্তমানকন্ঠ ডটকম, জুরিখ, সুইজারল্যান্ড : সুইজারল্যান্ডের জুরিখে বাংলা স্কুলের আয়োজনে বরাবরের মতো এবারেও যথাযোগ্য মর্যাদায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস এবং একদিনের বই মেলা অনুষ্ঠিত হয়।
স্কুলের লিমাটস্ট্রিটের ১১৪ নাম্বার ফয়ার হলে ছিল এই আয়োজন। অস্থায়ী শহীদ মিণার নির্মাণ করে এখানেই বরাবরের মতো এবারও দেশী এবং ভিনদেশীরা একত্রে মিলিত হয়ে একুশের গান গেয়ে বেদীতে ফুল দিয়ে ভাষা শহীদদের প্রতি সম্মান প্রদর্শণ করেন।
সম্মানীতদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন,
জুরিখের সাংসদ উরস হেলপেন স্টাইন, জুরিখ সার্কেল ৫ এর উন্নয়ন সমিতির কর্মকর্তা, নারী অধিকার কর্মী এবং আসছে নির্বাচনে সাংসদ পদে নির্বাচন করতে যাওয়া সবুজ দলের নেত্রী সান্দ্রা বেনেক, সুবর্নমালা, কুন্ডিটা এবং চিন্ময় সেন্টারের বন্ধুরা।
আগামীতে জুরিখের মেইন স্টিম, স্থানীয় সার্কেল ৫ এর এসোসিয়েশনই দিবসটি সবাইকে সাথে নিয়ে বিশেষ ভাবে পালন করবার পরিকল্পনার বিষয়ে কথা বলেন এসোসিয়েশনের কর্মকর্তা সান্ত্রা এবং জুরিখের সাংসদ উরস হেলপেন স্টাইন যিনি গত ৫ বছর ধরে সব সময় প্রবাসী বাংলাদেশীদের জাতীয় দিবসগুলোর অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণ করে থাকেন।
হেলপেন স্টাইন আরো বলেন, সুইজারল্যান্ডে রয়েছে চারটি রাষ্ট্র ভাষা এবং কেবল মাত্র জুরিখে বসবাসরত দেশী বিদেশী বাসিন্দারাই এখানে প্রায় ১ শত ৬০ টি ভাষায় কথা বলে থাকেন। জুরিখের মতো বহু ভাষার বৈচিত্রময় একটা শহরে আন্তজার্তিক ভাষা দিবসের গুরুত্ব অত্যন্ত বেশী।
তিনি আশা করছেন, অচিরেই দিবসটি জুরিখ প্রশাসন নিজেই গুরুত্ব সহকারে পালন করবে।
এবারো শহীদ মিণারের পাদদেশে সবার সাথে একুশের গান এবং জাতীয় সংগীত পরিবেশনা করেন বাংলা স্কুলের সহযোগী সংগঠন জুরিখের শ্রী চিন্ময় সেন্টারের সুইজ বন্ধুরা।
একুশের গান, “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো” গানটির অন্তরকারা তালে উপস্থিত সবাই অস্থায়ী শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
প্রবাসে দিবসটি ছুটির দিন না হবার কারণে যে যার মতো করে সময় মিলিয়ে শহীদ মিণারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করে যান অন্য সবাই।
সবার জন্য সারাদিনই উম্মুক্ত থাকে এই শহীদ মিণার। তাছাড়া এই শহীদ মিনারটি অস্থায়ীভাবে বার মাসই স্থাপন থাকে জুরিখের ডামভেগ ট্রাম স্টেশন সংলগ্ন ৬ নাম্বার ডামভেগের কিওচকের সামনে। যে কেউ যখন তখন এখানে শহীদের সম্মান প্রদর্শণের সুযোগ রাখেন।
একুশের দিনে মূল কর্মসূচিতে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায়
উপস্থিত শিশু কিশোরদের সামনে মাতৃভাষা দিবসের তাৎপর্য্য ব্যাখ্যা করে বক্তব্য রাখেন, সুইজ প্রবাসী বাংলাদেশীদের মধ্যে স্বপন হালদার, আকবর হোসেন, জাকির হোসাইন, রুবেন আহম্মেদ সোহেল সহ আরো অনেকে।
এসময়ে স্বপন হালদার বলেন, প্রবাসের স্কুল কলেজে গুলো থেকে জাতীয় এই দিবস বিষয়ে জানবার কোন সুযোগ নেই। তাই বাংলা স্কুলগুলোর এই সব কার্যকলাপ এবং কর্মসূচির মধ্য দিয়েই প্রবাসে আমাদের শিশুদেরকে শিক্ষা দেবার ব্যবস্থা করতে হবে এবং এ কাজে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
আকবর হোসেন সবার উদ্দশ্যে বলেন, একুশের এই দিবসটিতে নিয়মিত বড় পরিসরে একটা বই মেলা করারও আমাদের খুবই দরকার।
রুবেন আহম্মেদ সোহেল তার বক্তব্যে বলেন, ভাষা শহীদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের এই দিবসটি প্রবাসেও ভুলবার কোন সুযোগ নেই। তাই তিনি সারাদিন কাজ শেষে ক্লান্ত শরীরে নিজের সন্তানকে নিয়ে এসেছিলেন অস্থায়ী শহীদ মিনারে ফুল দিতে। তার সন্তান এখন জানেন “একুশ” আসলে কী?
এটাই গর্বের বিষয়। প্রবাসের প্রতিটা সন্তানকেই আমাদের দিবসটির তাৎপর্য অবশ্যই শিখাতে এবং জানাতে হবে।
সারাটা জীবন এ দিবসটিতে যিনি দেশে কেন্দ্রীয় শহীদ মিণারে ফুল দিয়ে এসেছেন, তিনি গত ৪ টা বছর প্রবাসে থাকার কারণে সে কাজটি করতে পারেননি। তিনি জুরিখ প্রবাসী প্রকৌশলী সুলতানা।
জুরিখের অস্থায়ী শহীদ মিনারে এসে সুলতানা তার আবেগ ধরে রাখতে পারেননি। অকপটে একুশের গান গাইতে গাইতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদনের সময় তিনি কেঁদেই ফেলেছিলেন।
চার বছর পর বিদেশের মাটিতে তিনি দিবসটি পালন করেছেন। পাঁচ বছরের সন্তান এবং গুগল সুইজারল্যান্ডে কর্মরত প্রকৌশলী স্বামীকে নিয়ে তিনি অস্থায়ী শহীদ মিনারে ফুল দিতে এসেছিলেন।
তিনিও তার সম্তানকে যে কোন মূল্যে শিকড়ের সন্ধান দিতে প্রস্তুত।
অনুষ্ঠানে একুশের গান পরিবেশন করেন স্থানীয় শিল্পী মুন বনিক এবং জাকির হোসাইন। আগেই বলা হয়েছে, একুশ উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠানে ছিল দিন ব্যাপি বইমেলা। যে মেলার উদ্দেশ্য শুধু বই বিক্রি নয় বরং বইগুলো কিছুক্ষনের জন্য একটু নেড়ে চেড়ে উল্টে পাল্টে দেখা। পিছনে ফিরে তাকিয়ে একটু জাবরকাটা।
ডিজিটাল এই ইন্টারনেটের যুগে প্রবাসে কেউ মোটেই বই পড়তে চায় না, আবার চাইলেও প্রবাসে প্রয়োজনীয় বই পাওয়া যায় না। তাই বইয়ের দিকে মুখ ফেরাতেই কতৃপক্ষের এই একদিনের বই মেলার আয়োজন এবং প্রচেষ্ঠা।
আয়োজকবৃন্দ জাতীয় দিবস গুলো পালনে সবাইকে সহযোগীতার হাত বাড়ানোর আহবান জানান। তারা আরো জানান, জাতীয় দিবস গুলো পালনে শিশুদের আগ্রহের কোন কমতি বা অভাবই এই প্রবাসে দেখা যায় না। প্রকৃত পক্ষে আগ্রহ, অবহেলা এবং অলসতাটা রয়েছে শিশুদের পিতা মাতা এবং গার্ডিয়ানদের মাঝে।একটু বয়স বাড়লেই কিশোরদের আগ্রহ কমতে থাকে যা খুব স্পষ্টতই দেখা যায়। তখন শত চেষ্টা করেও তাদেরকে পথে টানা যায় না। অথচ দিনের বহু সময় তারা ব্যায় করে সেস্যাল মিডিয়া সহ ভিডিও গেইমসে।
সে কারণে প্রবাসে সময়মতো শিশুদের শিক্ষা প্রদানের বিষয়টি সবাইকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে। সকল বাঁধা বিপত্তি অতিক্রম করে, জাতীয় দিবসগুলো যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করে যেতে হবে। এটাই হোক অমর একুশের এই পবিত্র দিনের সবার অঙ্গিকার।