নিউজ ডেস্ক,বর্তমানকণ্ঠ ডটকম: ১৮ ডিসেম্বর ২০১৭ সোমবার সারাদেশে পালিত হয়েছে আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস । এ দিবসের প্রাক্কালে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি বলেন, গত জানুয়ারি মাস থেকে এ পর্যন্ত এক লাখ ১৮ হাজার নারীকর্মীসহ মোট ৯ লাখ ৬৩ হাজারেরও বেশি কর্মী কাজের উদ্দেশ্যে বিদেশে গেছে। বছর শেষে এ সংখ্যা ১০ লাখ ছাড়াবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশি নারীকর্মীদের বিদেশে যাওয়ার হার বেড়েছে। তবে সেই সঙ্গে বিদেশে, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে তাদের ওপর নিপীড়নের অভিযোগ উঠেছে। দেশের বাইরে বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশির সংখ্যা প্রায় ৭৫ লাখ। সে হিসাবে বাংলাদেশি অভিবাসীরা বিশ্বে পঞ্চম শীর্ষ স্থানে আছে। আর তাদের কাছ থেকে বাংলাদেশে প্রতিবছর যে রেমিট্যান্স আসে, তা বিশ্বে রেমিট্যান্সের হিসাবে নবম সর্বোচ্চ। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক অভিবাসী সংস্থা (আইওএম) প্রকাশিত ‘বিশ্ব অভিবাসী প্রতিবেদন ২০১৮’-তে এসব তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী বলেছেন, এ বছর মন্ত্রণালয় বিদেশে বাংলাদেশি নারীকর্মীদের ওপর নিপীড়নের ৯টি অভিযোগ পেয়েছে এবং সেগুলোর বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
মন্ত্রী জানান, অভিযোগ পেলেই তাঁরা সংশ্লিষ্ট দেশে বাংলাদেশের দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করে সমস্যার সুরাহা করে থাকেন।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব নমিতা হালদার বলেন, বিদেশে কর্মী যাওয়ার হার কম এমন জেলাগুলো থেকে এবং দক্ষ কর্মী পাঠানোর ওপর সরকার গুরুত্ব দিচ্ছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যের আলোকে বিদেশে যাওয়ার আগেই অভিবাসীকর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।
রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ এক বাণীতে অভিবাসী নারীপুরুষ ও তাদের পরিবারের সদস্যদের সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিত করতে সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক বাণীতে বলেছেন, বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে মানবপাচারবিরোধী আইন কঠোরভাবে বাস্তবায়নের পাশাপাশি অভিবাসন ব্যয় সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে বিশ্বের সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।
হালনাগাদ তথ্য-উপাত্তে দেখা যায়, ২০১৬ সালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত ব্যক্তির সংখ্যা ছিল চার কোটি তিন লাখ এবং শরণার্থী ছিল দুই কোটি ২৫ লাখ। আইওএম এ প্রতিবেদন তৈরির সময় বিশ্বে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছেছে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী মিয়ানমার ছেড়ে আসা অব্যাহত রেখেছে। আইওএমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিরাপদ অভিবাসনের ফলে অভিবাসী, তার পরিবার ও দেশ উপকৃত হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, অভিবাসীকর্মীরা প্রায় একই ধরনের কাজ করে নিজ দেশে যত মজুরি পেত তার চেয়ে বেশি মজুরি পায় বিদেশে। বৈদেশিক কর্মসংস্থানের সুযোগ অভিবাসীদের নিজ দেশে বেকারত্বের হার কমাতে ও দারিদ্র্য বিমোচনে সহায়ক হয়েছে।
এই দিনে আমরা সারা বিশ্বে ১৫ কোটি ৮০ লাখ অভিবাসীর ভূমিকা ও আবশ্যকতার স্বীকৃতি পালন করি। বিশ্বের সর্বত্রই অভিবাসীরা অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অগ্রগতিতে ভূমিকা রাখে।
এদিকে আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস উপলক্ষে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, এই দিনে আমরা সারা বিশ্বে ১৫ কোটি ৮০ লাখ অভিবাসীর ভূমিকা ও আবশ্যকতার স্বীকৃতি পালন করি। বিশ্বের সর্বত্রই অভিবাসীরা অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অগ্রগতিতে ভূমিকা রাখে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিশ্বজুড়ে অভিবাসীদের প্রতি বৈরিতা বাড়ছে। তাই অভিবাসীদের প্রতি সহমর্মিতা জানানো এবারের মতো জরুরি আর কখনো হয়নি। তিনি বলেন, গত বছর বিশ্বনেতারা ২০১৮ সালে নিরাপদ, সুশৃঙ্খল ও নিয়মতান্ত্রিক অভিবাসনের জন্য ‘গ্লোবাল কমপ্যাক্ট’ প্রণয়নের অঙ্গীকার করেছিলেন। তিনি এ বিষয়ে অগ্রগতি প্রত্যাশা করছেন। অন্যদিকে আইওএম মহাপরিচালক উইলিয়াম ল্যাসি সুইং নিরাপদ অভিবাসনের ওপর জোর দিয়েছেন।
সম্প্রতি প্রকাশিত আইওএমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৫ সালে বিশ্বে আন্তর্জাতিক অভিবাসীর সংখ্যা ছিল ২৪ কোটি ৪০ লাখ। এটি বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৩.৩ শতাংশ। তবে আন্তর্জাতিক অভিবাসীদের চেয়ে নিজ নিজ দেশে বাস্তুচ্যুত হয়ে এক স্থান থেকে অন্যত্র যাওয়া অভিবাসীর সংখ্যা বেশি। ২০০৯ সালে সারা বিশ্বে অভ্যন্তরীণ অভিবাসীর সংখ্যা ছিল ৭৪ কোটি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক—উভয় ক্ষেত্রেই বাস্তুচ্যুতির হার বেড়েছে। এ ক্ষেত্রে বেসামরিক ও আন্তর্দেশীয় সংঘাত, যুদ্ধক্ষেত্রের বাইরে সহিংস উগ্রবাদের প্রভাব রয়েছে।
পঞ্চম শীর্ষে বাংলাদেশ (প্রায় ৭৫ লাখ)। এরপর আছে যথাক্রমে পাকিস্তান, ইউক্রেন, ফিলিপাইন, সিরিয়া, যুক্তরাজ্য, আফগানিস্তান, পোল্যান্ড, কাজাখস্তান, জার্মানি, ইন্দোনেশিয়া, রোমানিয়া, মিসর, তুরস্ক, যুক্তরাষ্ট্র ও ইতালি।
বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯০ সালে অভিবাসীরা সে সময়ের নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে সাত হাজার ৪০০ কোটি মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছে। ২০১৬ সালে তা দাঁড়িয়েছে ৪২ হাজার ৯০০ কোটি মার্কিন ডলারে। বৈশ্বিকভাবে রেমিট্যান্স এখন সরকারি উন্নয়ন সহযোগিতার তিন গুণেরও বেশি। অভিবাসনের ফলে দক্ষতা, জ্ঞান ও প্রযুক্তি স্থানান্তরের যে সুযোগ সৃষ্টি হয় তা পরিমাপ করা কঠিন। তবে তা উৎপাদন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। বিশেষ করে সংঘাত-পরবর্তী পুনর্গঠন ও উদ্ধারকাজে অভিবাসীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ক্রমেই জোরালো হচ্ছে। জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিভাগের (ইউএন-ডেসা) তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭০ সাল থেকেই আন্তর্জাতিক অভিবাসীদের প্রধান গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র। এ তালিকায় দ্বিতীয় শীর্ষে আছে জার্মানি, তৃতীয় শীর্ষে রাশিয়া। এরপর আছে যথাক্রমে সৌদি আরব, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, স্পেন, ইতালি, ভারত, ইউক্রেন, থাইল্যান্ড, পাকিস্তান, কাজাখস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকা, জর্দান, তুরস্ক ও কুয়েত।
অন্যদিকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অভিবাসীর হিসাবে শীর্ষে আছে ভারতীয়রা। ২০১৫ সালের হিসাব অনুযায়ী, তাদের সংখ্যা দেড় কোটিরও বেশি। এ তালিকায় দ্বিতীয় শীর্ষে আছে মেক্সিকো (প্রায় এক কোটি ৩০ লাখ)। তৃতীয় শীর্ষে রাশিয়া (এক কোটিরও বেশি), চতুর্থ শীর্ষে চীন (প্রায় এক কোটি) এবং পঞ্চম শীর্ষে বাংলাদেশ (প্রায় ৭৫ লাখ)। এরপর আছে যথাক্রমে পাকিস্তান, ইউক্রেন, ফিলিপাইন, সিরিয়া, যুক্তরাজ্য, আফগানিস্তান, পোল্যান্ড, কাজাখস্তান, জার্মানি, ইন্দোনেশিয়া, রোমানিয়া, মিসর, তুরস্ক, যুক্তরাষ্ট্র ও ইতালি। আইওএমের প্রতিবেদনে শীর্ষ রেমিট্যান্স গ্রহণকারী ১০ দেশের যে ছক প্রকাশ করা হয়েছে তাতে ২০০০ ও ২০০৫ সালের হিসাবে বাংলাদেশের নাম নেই। তবে ২০১০ ও ২০১৫ সালের হিসাবে বাংলাদেশ নবম শীর্ষ রেমিট্যান্স গ্রহণকারী হিসেবে তালিকায় স্থান পেয়েছে। ২০১০ সালে বাংলাদেশে এক হাজার ৮৫ কোটি মার্কিন ডলার ও ২০১৫ সালে এক হাজার ৫৩৮ কোটি মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে।
ওই তালিকায় শীর্ষে আছে ভারত। দেশটি ২০০০ সালে এক হাজার ২৮৪ কোটি মার্কিন ডলার, ২০০৫ সালে দুই হাজার ৩৬৩ কোটি মার্কিন ডলার, ২০১০ সালে পাঁচ হাজার ৩৪৮ কোটি মার্কিন ডলার এবং ২০১৫ সালে ছয় হাজার ৮৯১ কোটি মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স পেয়েছে। অনিয়মিত ও ঝুঁকিপূর্ণ অভিবাসী এখনো সমস্যা। কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, বিশ্বের অনেক দেশের নাগরিকদের মতো বাংলাদেশিদের বিদেশে অনিয়মিত ও ঝুঁকিপূর্ণ অভিবাসনের প্রবণতা বেশ বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অবৈধভাবে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে আনতে প্রবল চাপের মুখে বাংলাদেশ এ বছর ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সঙ্গে একটি ‘স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর’ (এসওপি) সই করেছে। ইউরোপে ৮০ থেকে ৯০ হাজার বাংলাদেশি অবৈধভাবে অবস্থান করছে বলে ধারণা করা হয়। জানা গেছে, গত ১৪ ও ১৫ ডিসেম্বর বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে এসওপিসংক্রান্ত যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের প্রথম সভা হয়েছে।
প্রবাসী বাংলাদেশিদের সমস্যার কথা জানতে গতকাল তিনটি হটলাইট উদ্বোধন করা হয়েছে। এগুলো হলো +৮৮০১৭৮৪-৩৩৩৩৩৩, +৮৮০১৭৯৪-৩৩৩৩৩৩ এবং +৮৮০২-৯৩৩৪৮৮৮।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, ইউরোপীয় দেশগুলোর কাছ থেকে পাওয়া তালিকার ভিত্তিতে পরিচয় যাচাই করে বাংলাদেশ পর্যায়ক্রমে তাদের ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেবে। জার্মানি ও ডেনমার্ক ইতিমধ্যে তাদের দেশে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের তালিকা পাঠিয়েছে। ডেনমার্কে কথিত অবৈধ বাংলাদেশিদের পরিচয় যাচাইয়ের জন্য একটি প্রতিনিধিদল বর্তমানে কোপেনহেগেন সফর করছে। ধারণা করা হচ্ছে, ওই বাংলাদেশিদের অনেকে বৈধভাবে ইউরোপে যাওয়ার পর নানা কারণে অবৈধ হয়ে গেছে। আবার অনেকে অবৈধভাবেও ইউরোপে গেছে। তবে তারা সরাসরি বাংলাদেশ থেকে নয়, বরং অন্য কোনো দেশ থেকে ইউরোপে গেছে। কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, লিবিয়ায় যুদ্ধ ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে সেখানে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের বড় একটি অংশ সাগরপথে অবৈধভাবে ইউরোপে পাড়ি জমানোর চেষ্টা করেছে। তবে তারা কত জন ইউরোপে পৌঁছতে পেরেছে সে বিষয়ে নিশ্চিত কোনো তথ্য পাওয়া যায় না।
এদিকে ইউরোপীয় সীমান্ত ও উপকূলরক্ষী বাহিনী ফ্রনটেক্সের গত ১১ ডিসেম্বর প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, গত নভেম্বরেও সাড়ে ১০ হাজার অভিবাসীপ্রত্যাশী অবৈধভাবে ইউরোপে ঢুকেছে। তবে এ সংখ্যা আগের বছরের নভেম্বর মাসের চেয়ে ২৭ শতাংশ কম। তবে ওই বিজ্ঞপ্তিতেও বাংলাদেশের নাম আছে। এ বছরের প্রথম ১১ মাসে মধ্য ভূমধ্যসাগর রুট ব্যবহার করে অবৈধভাবে ইতালিতে পৌঁছা অভিবাসীপ্রত্যাশীদের মধ্যে শীর্ষে আছে নাইজেরিয়ার নাগরিকরা। এরপর আছে যথাক্রমে ঘানা, নাইজেরিয়া ও বাংলাদেশের অভিবাসীপ্রত্যাশীরা।
প্রবাসী বাংলাদেশি কর্মীদের অনেকে অত্যন্ত প্রতিকূল পরিস্থিতিতে কাজ করেন এমন অভিযোগও রয়েছে। গত এক দশকে বিদেশ থেকে লাশ হয়ে ফিরেছেন ২৫ হাজারেরও বেশি বাংলাদেশি কর্মী। এদিকে প্রবাসী বাংলাদেশিদের সমস্যার কথা জানতে গতকাল তিনটি হটলাইট উদ্বোধন করা হয়েছে। এগুলো হলো +৮৮০১৭৮৪-৩৩৩৩৩৩, +৮৮০১৭৯৪-৩৩৩৩৩৩ এবং +৮৮০২-৯৩৩৪৮৮৮। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় জানায়, বাংলাদেশ সময় প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত এ লাইনগুলো চালু থাকবে।