অভিবাসী? পৃথিবীর বর্তমান মানব সভ্যতায় অভিবাসী নামটি যেনো লজ্জার সমীকরণ। কারণ নিজ জন্মভূমি ছেড়ে দেশান্তরিত হওয়া মানব সম্প্রদায় অন্য দেশের মৌল স্রোতের সাথে মিশে যেতে হলে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। আবার এই মানবগোষ্ঠীকে পছন্দের দেশ বা নিরাপদ দেশে পৌছার পথিমধ্যে সাগরে নৌকায় ডুবে, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট, শ্বাসরুদ্ধ, সীমান্ত কাটাতার কিংবা ডিটেনশন সেন্টারে তালাবদ্ধ ঘরে মানবেতর জীবন কাটাতে হয়।
আমরা আবার এই অভিবাসীকে বিভিন্ন নামে আখ্যায়িত করেছি। নিজ দেশ ছেড়ে অন্য দেশে পাড়ি দেয়া মানুষকে কীসের ভিত্তিতে ভিন্ন নামকরণ করা হয়? এই দেশান্তরিত মানবগোষ্ঠীকে সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিবাসন বিষয়ক কেন্দ্রের শিক্ষক শার্লট টাইলর-শরণার্থী, অভিবাসী ও আশ্রয় প্রার্থী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
১৯৯০ সালে অভিবাসী শ্রমিক ও দেশে ফেলে আসা তাদের পরিবারের নিরাপত্তা রক্ষায় আন্তর্জাতিক সম্মেলন করে জাতিসংঘ। এরই প্রেক্ষাপটে ১৮ ডিসেম্বরকে লক্ষ্য করে মাইগ্রেন্ট রাইটস ইন্টারন্যাশনাল, ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন অন মাইগ্রেন্টস রাইটসসহ বিশ্বের অনেক সংগঠন অভিবাসীদের স্বার্থ রক্ষার্থে বৈশ্বিকভাবে প্রচারণা চালায়। পরবর্তীতে ২০০০ সালের ৪ ডিসেম্বর বিশ্বব্যাপী ১৮ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয় জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ। পৃথিবীর সৃষ্টির ইতিবৃত্তে অভিবাসী বা শরণার্থীর ক্ষেত্রে কি পরিচয় বহন করে? শুধু মানুষই নয়, জগতের সকল জীবজন্তুই খাদ্য, বাসস্থান এবং স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপনের অনুকুল পরিবেশে থাকার জন্য এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিরন্তর যাত্রা করেছে। সেখানে ভালো না লাগলে বা প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে অথবা অধিকতর ভালো জায়গার সন্ধান ফেলে তাতেই পারি জমিয়েছে। এটি সেই প্রাণিজগতের জীবজন্তুর জীবনযাত্রা শুরু থেকে এখনও চলছে।
বর্তমান আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় মানবগোষ্ঠীকে অভিবাসিত বা শরণার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে তৃতীয় বিশ্বের নাগরিকদের যেমন অর্থনৈতিক কারণ রয়েছে। ঠিক তেমনি রাজনৈতিক হুলিয়া, সামাজিক নিরাপত্তা ও স্বাধীকার আন্দোলন বিদ্যমান। মায়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী রাষ্ট্রীয় দমন-পিড়নে অভিবাসী বা শরণার্থী হয়ে বাংলাদেশ আশ্রয় নিয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার যতটা মানবিকতার পরিচয় দেয়ার কথা তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধার করার পায়তারা করেছে।
অভিবাসী হওয়ার ঢলে সারা বিশ্বে বাংলাদেশিদের অবস্থান ষষ্ঠ। বাংলাদেশের ৭৮ লাখ মানুষ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাস করছেন। তাঁদের বেশির ভাগই জীবিকার তাগিদে শ্রমিক হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ গুলোতে অস্থায়ীভাবে অভিবাসন নিয়েছেন। আবার কেউ উন্নত জীবনের প্রত্যাশায় যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়ার মতো উন্নত দেশে স্থায়ী অভিবাসী হয়েছেন। তিন দশকের ব্যবধানে বাংলাদেশি অভিবাসীর সংখ্যা ৪০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। গত এক দশকে গণতন্ত্র রক্ষার আন্দোলনে ১০ শতাংশের বেশি মানুষ দেশান্তরিত হয়ে অভিবাসী বা শরণার্থী হিসেবে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়েছে। এই অভিবাসী দিবসে অভিবাসী বা শরণার্থীদের কোন ধর্ম নেই, দেশ নেই, সাদা-কালোর কোন বৈষম্য নেই। তাদের একটাই পরিচয় ওরা মানুষ। তাই মানুষকেই বাচাঁতে হবে। মানুষই পৃথিবীর সৌন্দর্য।
লেখকঃ সাংবাদিক ও কলামিস্ট। প্যারিস-ফ্রান্স।