শুক্রবার, ১১ অক্টোবর ২০২৪, ০২:৩৫ অপরাহ্ন

শোকাবহ আগস্ট – দুর্বৃত্ত, দুর্নীতি এবং খাব-খাব উচ্চারণে বঙ্গবন্ধুর দর্শন, আর্দশ, ত্যাগ কতটুকু জাগরিত?

বর্তমানকণ্ঠ ডটকম / ১১ পাঠক
মঙ্গলবার, ৩১ আগস্ট, ২০২১

শোকাবহ আগস্টের শেষ দিন আজ। ১৯৭৫ সালের এ মাসে বাঙালি জাতি হারিয়েছে তার হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর শেখ হাসিনাকে হত্যা করে বঙ্গবন্ধুর সব আলো নিভিয়ে দেয়ার শেষ চেষ্টা ছিল ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট। ১৫ আগস্টেরই ধারাবাহিকতায় ২১ আগস্টের উদ্দেশ্য ছিল একই। যার জন্য বাঙালির হৃদয়ে আগস্টের স্থান হয়েছে বহুমাত্রিক দুঃখ, কস্ট ও কান্নার মাস হিসেবে। শোকাবহ কান্নার আগস্ট এলে দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে সবসময় কিছু লেখার চেষ্টা করি। নানান ব্যস্ততার কারণে এবছর আগস্টের অন্তিম লগ্নে এসে আমার সেই অভিপ্রায়ের প্রতিফলন হয়েছে।

আমার জন্মের দুই মাস পরেই ষড়যন্ত্রকারী এবং বিপথগামী সেনাদের হাতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নির্মমভাবে খুন হোন। যখন শৈশবের দূরান্ত সোনালী সময় অতিক্রম করছি, যখন রাজনীতি, দলবাজি, বলবাজি বুঝার বয়স হয়নি; শৈশবের সেই নির্মল ও নির্লোভ সময়ে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের সেই তেজোদীপ্ত ভাষণ শুনে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং বঙ্গবন্ধুর আর্দশের প্রতি অনুপ্রাণিত হই।
ইউনেস্কোর তালিকায় স্থান পাওয়া বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ১৮ মিনিটের শ্রেষ্ঠ একটি ভাষণ সেদিন পাল্টে দিয়েছিল পৃথিবীর মানচিত্র। যেই ভাষণ স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র জন্মের ভিত্তি তৈরি করে দিয়েছিল। ‘পৃথিবীতে প্রতিটি সৎ এবং মহৎ সংগ্রাম যা সংগঠিত হয়েছে তাঁর জন্ম হয়েছে মহৎ বক্তার বক্তৃতা থেকে।’ এই উক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্ম হয়েছিল ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণের মাধ্যমে।

কেউ কেউ বলেন, বাঙালি নাকি বিস্মৃতিপরায়ণ জাতি। কিন্তু সত্যিকারের অমূল্য স্মৃতি বাঙালি জাতি যে সম্পদ হিসেবে আঁকড়ে থাকতে পারে তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তাঁর ৭ মার্চের ভাযণ। যেই ভাষণ নিয়ে লেখা হয়েছে অসংখ্য গান, কবিতা, গল্প আরো কত কিছু। শ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসাবে ইউনেস্কোর স্বিকৃতিপ্রাপ্ত হওয়ার পর এই ভাষণ এখন আর কোনো নির্দিষ্ট দেশের এবং দলের একক নয়। এই সম্পদ পুরো বিশ্বের। তাই তো ঘরে ঘরে আজ শোনা যায়, দরাজ কন্ঠের সেই ‘ভাইয়েরা আমার ‘ আহ্বান। শিশুরাও আজ অনুকরণ করে তাদের প্রিয় বঙ্গবন্ধুকে।

১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু ছয় দফা ঘোষণার পর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) এর পূর্ব পাকিস্তান প্রধান অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনি এই যে ৬ দফা দিলেন তার মূল কথাটি কী? আঞ্চলিক ভাষায় এই প্রশ্নের উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন: ‘ আরে মিয়া বুঝলা না, দফা তো একটাই। একটু ঘুরাইয়া কইলাম।’ ঘুরিয়ে বলা এই এক দফা ছিলো পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা।
ছয় দফা দাবীর আগে বিভিন্ন সময়ে পূর্ব বাংলার স্বাধিকার আন্দোলনের দাবি উঠেছে। কিন্তু ছয় দফার দাবির মধ্য দিয়ে এটি একক এজেন্ডায় পরিণত হয়। অনেকে তখন এসব দাবিকে “রাজনৈতিক বোমা” বলে উল্লেখ করেছেন।

১৯৬৬ সালে এ ছয় দফা প্রণয়নের পর এটি গ্রহণ করে পক্ষে থাকার জন্য বঙ্গবন্ধু বিশিষ্ট রাজনীতিক আতাউর রহমান খানসহ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান এবং পাকিস্তানের বিরোধী দলের সব নেতার কাছেই গিয়েছিলেন। কিন্তু ছয় দফা নিয়ে অগ্রসর হলে ‘ ফাঁসিতে ঝোলানো হবে ’ এমন ভয় থেকে কোনো নেতাই বঙ্গবন্ধু আহবানে এগিয়ে আসেননি। বঙ্গবন্ধু নিজেই তখন সিদ্ধান্ত নেন ছয় দফা নিয়ে তিনি জনগণের কাছে যাবেন। বঙ্গবন্ধু জনগণের কাছে গিয়ে তখন ছয় দফা পক্ষে জনজাগরণ সৃষ্টি করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ছয় দফায় পাকিস্তানি শাসকের ভিত এতটাই কেঁপে গিয়েছিল যে ‘আপত্তিকর বক্তব্য’ দেয়ার অজুহাতে তাঁকে তখন গ্রেফতার করা হয়। ১৯৬৬ সালের ৮ মে থেকে ১৯৬৯’র ২২ ফেব্রুয়ারি অর্থাৎ একটানা ৩৩ মাস কারাবন্দি ছিলেন প্রিয় নেতা জাতির পিতা। বঙ্গবন্ধুর ১৪ বছরের কারাজীবনে এটাই ছিল তাঁর দীর্ঘ কারাবাস।

বঙ্গবন্ধু কারাগারে থাকাঅবস্থায় পরবর্তীতে ছয় দফাকে ১১ দফায় অন্তর্ভুক্ত করে ১৯৬৯ সালে আন্দোলনে নামেন বাংলার ছাত্রসমাজ। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে আইয়ুব খান বিদায় নেন। ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি সব রাজবন্দির মুক্তির পর বঙ্গবন্ধু মুক্তিলাভ করেন। ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) লক্ষ লক্ষ মানুষের উপস্থিতিতে জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানকে তখন ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেয়া হয়।

১ মার্চ ১৯৭১ পাকিস্তানের সামরিক সরকার জেনারেল ইয়াহিয়া পূর্বনির্ধারিত জাতীয় পরিষদ সভা স্থগিত করলে বাংলার মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নেমে পড়ে ‘ স্বাধীনতা ‘ নামক এক দফার দাবিতে। ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ বঙ্গবন্ধু অসীম সাহসের সঙ্গে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। এরই ধারাবাহিকতায় ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বাংলার অবিসংবাদিত নেতা লাখ লাখ মুক্তিকামী মানুষকে শোনালেন তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতা –
‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু করেন বঙ্গবন্ধু। এরই ধারাবাহিকতায় তাঁর নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ শহীদ এবং দুই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হয়ে উঠেন বাঙালি জাতির মুক্তির পথপ্রদর্শক।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ষড়যন্ত্রকারী এবং বিপথগামী সেনাদের হাতে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নির্মমভাবে খুন হোন। খুনিরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে পারলেও তাঁর আর্দশ ও চেতনাকে হত্যা করতে পারেনি। তাইতো প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ের তিনি চিরকাল ভাস্বর হয়ে আছেন এবং থাকবেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ঐ পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড যারা ঘটিয়েছে তাদের বিচার করা যাবে না, শাস্তির আওতায় আনা যাবে না মর্মে খুনি মোশতাকরা তখন শুধু ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স জারি করে ক্ষান্ত হননি; তারা বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ ও অপপ্রচার অব্যাহত রেখে তাঁর ভাষণ প্রচার এবং নাম উচ্চারণও নিষিদ্ধ করেছে।

আমার শৈশব বয়সে ( আশির দশকে ) আইন করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করা বন্ধ ছিল। তখন ‘বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসি ‘ একথাটি বলতেও যেন ভয় এবং সংকোচ হতো ! বঙ্গবন্ধুর এবং আওয়ামী লীগের নাম নেওয়া যখন লজ্জা, ভয় ও সংকোচ ছিল সপ্তম শ্রেনীতে পড়ার সময় তখন আমি বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বাংলার মাটি থেকে নিঃশেষ করার হুমকি দিয়ে ” চির অম্লান শেখ মুজিব ” শিরোনামে একটি কবিতা লিখেছি। কবিতাটি তখন বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। শৈশবের লেখা আমার কবিতাটি ২০০১ সালে ঢাকা বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এবং তৎকালিন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার হাতে তুলে দেওয়ার পর তাঁর স্নেহাশিস পাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। পরবর্তীতে প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে দুঃসময়ে প্রতিকূল পরিবেশে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে জনসচেতনতা এবং জনমত তৈরিতে কাজ করেছি। এজন্য অনেক সময় অনেক হয়রানি এবং মানুষিক নির্যাতনের স্বীকারও হয়েছি। মাঝে মাঝে ব্যক্তিগত আর্কাইভের অমলিন স্মৃতিতে চোখ ভুলালে আবেগাপ্লুত হয়ে যাই। কখনো কখনো নোনা অশ্রু জিভে এসেও পড়ে।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একজন ছাত্র হিসেবে জেনেছি “রাষ্ট্র পরিচালনার বিষয়াবলির অনুশীলন এবং প্রয়োগে ভূমিকা রাখা”কে রাজনীতি বলে। রাজনীতি হলো দেশ পরিচালনার বিজ্ঞান। মেধা ও মননশীলতার সঙ্গে যার সম্পর্ক। দেশ ও জাতির কল্যাণ এ বিজ্ঞানের উপজীব্য বিষয়। তাই রাজনীতির মূল লক্ষ্যই হলো রাষ্ট্রের জনগণের কল্যাণ সাধন করা। নিজের আখের গোছানো নয়। রাজনীতি করে সততা ন্যায় নীতির মাধ্যমে দেশ পরিচালনায় অংশ নিয়ে যেভাবে দেশ ও জাতির সেবা করা যায় অন্য কোনো মাধ্যমে তা সম্ভব হয় না। রাজনীতির লক্ষ্য বাস্তবায়নে রাজনীতিবিদদের জনগণের পাশে থাকতে হয়, রাজপথে থাকতে হয়। তাই সেবার রাজনীতিতে রয়েছে ত্যাগ। আর এ কথা দ্বিধাহীন চিত্তে বলতে পারি যে, এদেশে ত্যাগের রাজনৈতিক দল বলতে এক বাক্যে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে বোঝানো হতো। এজন্য অতীতে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সোনালি দিনগুলোতে রাজপথে থেকে সততা নিষ্ঠার রাজনীতি শিখে জনগণের জন্য আন্দোলন সংগ্রাম করে রাজনীতিবিদ তৈরি হতো। উদাহরণ দেয়ার মতো এদেশে বিগত দিনে অনেক গুণি ত্যাগের রাজনীতিবিদের জন্ম হয়েছে। জাতীয়ভাবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শেরেবাংলা একে ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মত সৎ, গুণী ও ত্যাগী রাজনীবিদের জন্য বাংলাদেশ এক সময় বিশ্বের দরবারে ত্যাগী রাজনীতিকদের দেশ হিসেবে পরিচিত ছিলো। তাঁদের সৎ, যোগ্য নেতৃত্ব ও দৃঢ়প্রত্যয়ী মনোভাবের কারণেই এদেশের মানুষ একাত্তরে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। চাঁদপুরে আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ে থেকে নেতৃত্ব দানকারী সৎ ও নিষ্ঠাবান ব্যক্তিত্ব হিসেবে সমধিক পরিচিত সর্বজন শ্রদ্ধেয় আওয়ামী লীগ নেতা মরহুম আবদুল করিম পাটোয়ারী, অ্যাডভোকেট আবু জাফর মঈন উদ্দিন, অ্যাডভোকেট আবদুল আউয়াল, আবদুর রব, অ্যাডভোকেট মোঃ সিরাজুল ইসলাম, এম. শফিউল্লাহর নাম উল্লেখ করার মতো। যাদের সৎ ও দক্ষ নেতৃত্বে চাঁদপুরের আওয়ামী লীগের রাজনীতি সবার কাছে জনপ্রিয় ছিলো।

রাজনীতিতে আদর্শ ও ত্যাগের জন্যই বঙ্গবন্ধু টুঙ্গিপাড়ার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে নায়ক হয়ে উঠে এসেছেন জাতীয় অঙ্গণে, এরপর মহানায়ক হিসেবে দ্যুতি ছড়িয়েছেন বিশ্বমঞ্চে। বাংলার শোষিত, নির্যাতিত ও নিপীড়িত মানুষের মুক্তিই ছিল তাঁর জীবনের মূল লক্ষ্য ও আদর্শ। যে লক্ষ্য বাস্তবায়নে তিনি আজীবন শুধু সংগ্রামই করে গেছেন। বাংলার মানুষের অধিকার নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বারংবার জেল-জুলুমের শিকার হয়েছেন। মাত্র ৫৪ বছরের (১৯২০-১৯৭৫) জীবনকাল ছিল তাঁর। শৈশব ও কৈশোরকাল পেরিয়ে ৩০ বছরের মতো ছিল রাজনৈতিক জীবন। এর মধ্যে ১৩ (তের) বছরই তিনি কাটিয়েছেন জেলখানায়। মোট ১৮ বার কারারুদ্ধ হয়েছিলেন। ২৪টি মামলা তিনি সাহসের সঙ্গে লড়েছেন। মৃত্যুর সামনে থেকে ফিরে এসেছেন ২ বার। বস্তত জেল-জুলুম-নিপীড়ন যেন তাঁর জীবনে এক নিয়মিত অধ্যায়ে পরিণত হয়েছিল।

বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিজীবন বলতে কিছুই ছিলনা। রাজনীতি ও ক্ষমতার শীর্ষে থেকেও করেননি কোন টাকা- পয়সা কিংবা বাড়ি- গাড়ি। তাঁর চিন্তা-চেতনা, ধ্যান, সপ্ন, কর্ম সবই ছিল দেশের মানুষের মঙ্গলের জন্য। পুরো জীবনটাই ছিল বাঙালির জন্য নিবেদিত। তাই ফাঁসির মঞ্চকেও কখোনো তিনি ভয় পাননি। ভোগ নয়, রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ছিল ত্যাগের। বঙ্গবন্ধু রাজনীতিতে নীতি-আদর্শকে সর্বোচ্চ স্থান দিতেন। তাঁর রাজনীতির মূল দর্শন ছিল বাঙালির অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মুক্তি অর্জন। সারা জীবন নির্লোভ ও নির্মোহ থেকে বাংলার অবিসংবাদিত নেতা মানুষের অধিকার নিয়ে লড়াই করেছেন। মানুষের অধিকার আদায়ের প্রশ্নে তিনি ছিলেন সম্পূর্ন আপসহীন। অসাধারণ ধৈর্য, সাহস ও দৃঢ়তা নিয়ে তিনি তাঁর সুদীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রামে অসংখ্য অগ্নি-পরীক্ষার মধ্যদিয়ে পাকিস্তানি শাসক ও শোষকচক্রকে রুখে দাঁড়িয়ে একটি স্বাধীন দেশের জন্ম দিয়ে গেছেন। যা বিশ্বে বিরল।

বাংলাদেশকে নিয়ে জাতির পিতা যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেই সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্যে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন তাঁর সুযোগ্য উত্তরসুরী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধুর আর্শিবাদ সাথে নিয়ে তিনি এগিয়ে চলছেন। চারদিকে কত শত বাধা। তারপরও তিনি থেমে নেই। বাংলাদেশকে উন্নয়নের রোল মডেলে রূপান্ত্রিত করতে প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। কিন্তু কতিপয় দুর্বৃত্ত, দুর্নীতিবাজের বিষাক্ত নিঃশ্বাসে তৈরি হচ্ছে শূন্যতার! গুটি কয়েক রাজনীতিক, জনপ্রতিনিধি, আমলা, কামলার নোংরা ক্ষুধার জ্বালায় বিষয়ে তুলছে দেশ, জাতি, সমাজকে। বাধাগ্রস্থ করছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুকুমার পথচলার।

সততা ও নিষ্ঠার রাজনীতি দ্বারা ইহকালে যেমন প্রশংসিত হওয়া যায় তেমনি আখেরাতেও লাভ করা যায় নাজাত। ইতিহাস জ্বলজ্যান্ত সাক্ষী, বঙ্গবন্ধুর পুরো রাজনৈতিক জীবনে কোথাও একখণ্ড জমির মালিক হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী টাঙ্গাইলের সন্তোষপুরে একটি কুঁড়েঘরে বাস করতেন। যেই ঘরের বেড়া ছিল বাঁশের এবং দরজার মুখ ছিল ছালার চট দিয়ে ঢাকা। ১৯৭৬ সালের ১৭ নভেম্বর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি সপরিবারে বাস করেছেন ঐ ঘরে। অথচ তার সহধর্মিণী ছিল পাঁচ বিবির জমিদার পরিবারের মেয়ে।

বঙ্গবন্ধুর কারারক্ষী ছিলেন রাজনীতিবিদ মরহুম মহিউদ্দিন আহমেদ (বাকশালের চেয়ারম্যান)। তিনি রিকশায় চড়ে ধানমন্ডি ৩২ সড়কের বাড়ি থেকে জাতীয় সংসদে যেতেন। ১৯৯২ সালে একবার সংসদ ভবনের প্রবেশের মুখে পুলিশ তাঁর রিকশা আটকে দেয়। তিনি পরিচয় দেন, আমি এমপি, যেতে দাও বাবারা। পুলিশ বলল, স্যার দুঃখিত। সংসদ ভবনে রিকশা প্রবেশের অনুমতি নেই। শুধু গাড়ি প্রবেশের অনুমতি রয়েছে। আমাদের ক্ষমা করবেন। তখন আসাদ গেটের কোণা থেকে বয়োঃবৃদ্ধ মানুষটি পায়ে হেঁটে যান সংসদে। মন খারাপ করে পয়েন্ট অব অর্ডার তোলেন সংসদে। স্পিকার শেখ রাজ্জাক আলী তাকে ফ্লোর দেন। মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, মাননীয় স্পিকার! এই সংসদে শুধু গাড়ি প্রবেশের অধিকার আছে, রিকশা প্রবেশ করতে দেয়া হয় না। কিন্তু একজন এমপি যার গাড়ি নেই, তিনি সংসদে আসতে হলে তিনি কি হেঁটে আসবেন? তিনি জাতীয় সংসদে পুলিশ কর্তৃক তার রিকশা আটকে দেয়ার কাহিনী শোনান। সব শুনলেন স্পিকার শেখ রাজ্জাক আলী। তারপর দুঃখ প্রকাশ করে বললেন, আমাদের এই সংসদের সব সদস্য গাড়ি চড়ে আসেন না, গাড়ি না থাকায় রিকশায় চড়েও অনেক এমপি আসেন। তাদের অধিকার অবশ্যই রক্ষা করতে হবে (তথ্যসূত্র : সাংবাদিক নঈম নিজামের লেখা- চিরদিন কাহারো সময় সমান নাহি যায় )।

১৯৯১ সালেও আমাদের জাতীয় সংসদে রিকশায় চড়ে যাওয়ার এমপি ছিলেন। এখন সবকিছুই কল্পকাহিনী মনে হবে। চাঁদপুর পৌরসভার পর পর দু’বারের সফল চেয়ারম্যান, প্রাদেশিক আইন পরিষদের সদস্য এবং চাঁদপুর মহকুমা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মরহুম অবদুল করিম পাটোয়ারী চাঁদপুর শহরের তালতলা পাটাওয়ারী বাড়ির সেমিপাকা এক চালা টিনশেড ঘরে সারা জীবন জীবনযাপন করে গেছেন। চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি, সাবেক সংসদ সদস্য ও গণপরিষদ সদস্য অ্যাডভোকেট সিরাজুল ইসলামের চাঁদপুর শহরের কোথাও একখণ্ড জমি ছিল না। সরকারের পরিত্যক্ত একটি লিজ নেয়া বাড়িতে তিনি আমৃত্যু বসবাস করে গেছেন। সারা দেশে এভাবে অতীতে ত্যাগ ও সততার রাজনীতির অনেক উদাহারণ আছে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে। অথচ, তাঁদের রাজনীতির সময়েও ঠিকাদারী, টেন্ডারবাজি, মেঘনা নদীতে বালু মহাল, পরিবহনের চাঁদাবাজি ও লাইসেন্স প্রথা, পার্সেন্টিজ, ঘুষ, দুর্নীতি, তদবির, দরবার-কারবার ছিলো। কিন্তু, তাঁরা কোটি টাকার মালিক হয়ে গাড়ি-বাড়ি এবং আলিশান জীবন যাপনের স্বপ্ন দেখেননি। আর দেখেননি বলেই সৎ, গুণী ও ত্যাগী রাজনীতিবিদদের কথা উঠলেই মানুষ তাঁদের কথা এখনো শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে।

আওয়ামী লীগে এখন নেতা কর্মীর অভাব নেই। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও কর্ম থেকে শিক্ষা নিয়ে নিঃস্বার্থভাবে দেশের জনগণের সেবায় নিজেদের উৎসর্গ করার মতো রাজনীতিবিদের রয়েছে ব্যাপক অভাব। মুখে বঙ্গবন্ধুর কথা বলে, বঙ্গবন্ধুর নামে গগণ বিদারী স্লোগান দেয় কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ত্যাগ ও আদর্শ অন্তরে ধারে কাছেও নেই। এরা বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগের রাজনীতি করে সমর্থন করে যতটা না দেশের প্রয়োজনে তার চেয়ে বেশী তাদের ব্যক্তি স্বার্থের প্রয়োজনে।

পরিতাপের বিষয় হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর আর্দশ মুক্তিযুদ্বের চেতনার প্রতিফলন যখন প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর আগ্রাসনে ছিলো। তখন জীবত থেকেও যারা মরহুমের মত ছিল। বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আকাশের কালো মেঘ কেটে যাওয়ায় তারাই এখন অসময়ে নীরব সুসময়ে সরব হয়ে নব্য খন্দকার মোশতাক সেজে দল ও দেশের বারোটা বাজাচ্ছে! ১২ বছরের রাষ্ট্র ক্ষমতার আওয়ামী লীগে এখন নেতা, কর্মী সমর্থকের অভাব নেই। কালো টাকার মালিক, দুর্নীতিবাজ, চাঁদাবাজ, ধান্ধাবাজ, সন্ত্রাসী, অশিক্ষিত, চোর-বাটপার, মাদকসেবী, মাদক বিক্রেতা, মাফিয়া ও গডফাদারদের দাপট অনেক বেড়েছে আওয়ামী লীগে। চাটুকার, স্বার্থবাজ, পেশীশক্তি ও অরাজনৈতিক ব্যক্তি এবং অন্য দল থেকে আসা সুবিধাবাদী ব্যক্তিরা এখন আওয়ামী লীগের মূল নিয়ামক হয়ে উঠছে। এদের মধ্যে যার যত বড় পেশীশক্তি আছে, টাকা আছে, যত বড় গুন্ডা বাহিনী আছে, সে তত বড় নেতা হয়। যার তেলবাজ নেই, টাকা নেই, গুন্ডা বাহিনী নেই, সে যত ত্যাগী আর জ্ঞানীই হোক না কেন তাঁর মূল্য নেই। এসব মৌসুমী হাইব্রীড, সুবিধাবাদী, দুর্বৃত্ত, দুর্নীতিবাজরা আওয়ামী লীগের মন্ত্রী, এমপি, জনপ্রতিনিধি ও শীর্ষ নেতাদের আস্থাভাজন হয়ে অনেক ক্ষেত্রে দলের করিৎকর্মাও বনে যায়। চাটুকারিতা ও দলবাজিতে এরা ওস্তাদ হয়ে উঠে। সমাজ, দেশ, দল, জনগণ ডুবলে এদের কিচ্ছু যায় আসে না। চাঁদপুরের ত্যাগের রাজনীতিবিদদের জন্য সর্বজন শ্রদ্ধেয় মরহুম আবদুল করিম পাটোয়ারীর বিখ্যাত উক্তি-“কষ্ট হলেও সৎ থাকার চেষ্টা করো” এদের কাছে যেন উপেক্ষিত। এ নীতিবাক্যটি এখন যেন মরহুমের কবরের শ্বেতপাথরেই শোভা বর্ধন করে চলেছে।

এ প্রসঙ্গে সন্দেহাতীতভাবে বলতে পারি যে, আওয়ামী লীগ কখনও খারাপ সময়ে পড়লে এসব সুযোগসন্ধানী, মৌসুমী, হাইব্রীডদেরকে আর দেখা যাবে না। কারণ অতীতেও দেখা যায়নি। রাজনীতিতে শত্রু-মিত্র চিহ্নিত করার দুটো উপায় আছে- ১. নীতি ও আদর্শ ২. সুবিধাবাদ। দলের খারাপ সময়ে নীতি ও আদর্শের রাজনীতিবিদদের চেনা যায়, আর সুসময়ে চেনা যায় সুবিধাবাদীদের।

আজ বঙ্গবন্ধু নেই কিন্তু রয়েছে তাঁর মহান আদর্শ এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। `একজন নেতার মৃত্যু কেবল তার শারীরিক প্রস্থানে হয় না। তার প্রকৃত মৃত্যু ঘটে যখন তার আর্দশের মৃত্যু হয়।’ ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের অমরগাঁথা এই উক্তির মতো বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়তে হলে এবং বঙ্গবন্ধুর দর্শন, ত্যাগ ও আর্দশকে জাগ্রত এবং বাঁচিয়ে রাখতে হলে প্রত্যেককে স্বীয় অধিক্ষেত্রে সততা ও নিষ্ঠার সাথে কাজ করতে হবে। তবেই সফল এবং স্বার্থক হবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অক্লান্ত পরিশ্রম ও পথচলা।

লেখক : শাহাদাত হোসেন শান্ত, এম.এস.এস (রাষ্ট্রবিজ্ঞান), এলএল.বি; কবি, লেখক, শিক্ষক ও সাংবাদিক, চাঁদপুর।
৩০ আগস্ট ২০২১ খ্রিস্টাব্দ ।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই পাতার আওর সংবাদ