নিজস্ব প্রতিনিধি, বর্তমানকন্ঠ ডটকম, সৌদি আরব : সুখের আশা শোকে স্তব্ধ। সৌদি আরবে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত বাংলাদেশিদের অনেকেই ছিলেন তাদের পরিবারের একমাত্র আয়ের উৎস। তাদের এ মৃত্যুতে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে পরিবার এবং সন্তানদের ভবিষ্যৎ। শোকের পাশাপাশি পরিবারের সদস্যদের নতুন করে দুশ্চিন্তা ঘিরে ধরেছে । পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে অনেক টাকা ঋণ করে পাঠানো হয়েছিল। তাদের মৃত্যুতে ঋণ পরিশোধের চিন্তায় এখন বিহ্বল পরিবারগুলো। এ অবস্থায় নিহতদের লাশ দেশে আনাসহ সরকারের কাছে আর্থিক সহযোগিতা চেয়েছেন তারা।
নিহতদের মধ্যে একজন হলেন, টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার ঝগড়মান গ্রামের হাফিজ উদ্দিনের ছেলে বাহাদুর (৩৫) ।তিনি ছিলেন অসহায়-দুঃস্থ প্রতিবন্ধি পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। প্রতিবন্ধী স্ত্রী, একমাত্র সন্তান মেয়ে প্রতিবন্ধী, মা অসুস্থ, বাবা ও এক বাক-প্রতিবন্ধী বোন নিয়ে ছিলো বাহাদুরের সংসার । বাহাদুরের প্রতিবন্ধী স্ত্রী রাশেদা বলেন, আমাগোরে লাশটা আইন্যা দেন, আমগোরে সংসার এহন কেমনে চলবো, সুদি ঋণ কিবায় সুদাবো।
একই উপজেলার কস্তুুরিপাড়া গ্রামের শামছুল হকের ছেলে নিহত মনির হোসেন (২০)। নিহত মনির হোসেনের মা মমতাজ বলেন, আমার পোলার লাশটা আইন্ন্যা দেন। একথা বলেই তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। এক মাস আগে নিহত মনির হোসেনের বাবা ইরাক প্রবাসী শামছুল হক কাজ করার সময় মেশিনে বাম হাত গেলে চারটি আঙ্গুল কাটা পড়ে। বর্তমানে তিনি ইরাকের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন।
নিহত দুজনের বাড়ি নওগাঁর মান্দা উপজেলার কশব ইউনিয়নে। নিহতরা হলেন ওই ইউনিয়নের তেগাড়া গ্রামের তফিজ উদ্দিন মৃধার ছেলে গিয়াস উদ্দিন মৃধা ওরফে তোতা ও তুড়ুকবাড়িয়া গ্রামের রমজান আলীর ছেলে মানিক।
নিহত গিয়াস উদ্দিন তোতার পরিবার ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, এক মাস আগে ভাগ্যবদলের আশা নিয়ে সৌদি আরব পাড়ি জমান নিহত গিয়াস উদ্দিন মৃধা তোতা। সংসারে স্ত্রী শামীমা আক্তার, এক ছেলে সোয়াইদ মৃধা সাফি (১১) ও এক মেয়ে তানিশা আক্তারকে (৩) রেখে বিদেশ পাড়ি দিয়েছিলেন তিনি। মাথার ওপর ছিল সাড়ে ৩ লাখ টাকার ঋণের বোঝা। মাত্র এক মাসের ব্যবধানে সড়ক দুর্ঘটনায় তোতা নিহত হওয়ায় পুরো পরিবারে নেমে এসেছে অন্ধকার।
অন্যদিকে মানিক হোসেন, স্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিন, ছেলে শাহিন (৫) ও মেয়ে শাহিনারা (৩), বাবা রজমান আলী ও মা মানিকজান বিবিকে রেখে তোতার সঙ্গে সৌদি আরব যান।
নিহত ৩ জনের বাড়ি নরসিংদীর মনোহরদী উপজেলায়। নিহতদের বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। পরিবারের উপার্জনক্ষম মানুষকে হারিয়ে দিশেহারা তিনটি পরিবার। সংসারের সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতে এক মাস আগে সৌদি আরবে পাড়ি জমান তারা। নিহতরা হলেন- মনোহরদী উপজেলার তারাকান্দি গ্রামের মান্নান মাঝির ছেলে জামাল উদ্দিন মাঝি, শেখেরগাঁ গ্রামের রশিদ মিয়ার ছেলে ইমদাদুল ও খিদিরপুর গ্রামের আব্দুল মান্নান শেখের ছেলে মো. আল আমিন।
নিহত জামালের ভাই কামাল বলেন, চার লাখ টাকা ঋণ করে মাত্র ২৯ দিন আগে জামাল সৌদি আরবে যায়। তার ৪ ছেলে ও ১ মেয়ে রয়েছে। জামাল এখানে তরকারি বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করত। সংসারের সচ্ছলতা ফিরাতে বিদেশে পাড়ি জমায়। কিন্তু ভাগ্যে সহায় হলো না। টাকাও গেলো ভাইটাও গেল। সঙ্গে আমাদের কপালও পুড়ল।
নিহত ইমদাদুলের ভাই মোশারফ বলেন, ৩৬ দিন আগে ইমদাদুলকে বিদেশে পাঠিয়েছিলাম। এক মাস যেতে না যেতেই ভাইয়ের মৃত্যুর খবর। তা মানতে পারছি না।
পরিবার-পরিজনের জীবিকা নির্বাহে সৌদি আরব গিয়ে মাত্র এক মাস ছয় দিনের মাথায় সড়ক দুর্ঘটনায় লাশ হলেন কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলার মাধবপুর গ্রামের আনোয়ার হোসেনের পুত্র রফিকুল ইসলাম (৪৫)। তার মৃত্যুতে পরিবার ও স্থানীয়দের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। রফিকুলের ১৫ ও ১০ বছরের দুটি মেয়ে ও ৪ বছরের একটি ছেলে সন্তান রয়েছে। মৃত্যুর সংবাদ শোনার পরে তার বাড়িতে এখনও চলছে শোকের মাতম। নিহত রফিকুলের স্ত্রী হিরা খাতুন জানান, ধারদেনায় টাকা জোগাড় করে গত মার্চ মাসের ২৪ তারিখে রফিকুল সৌদি আরবে যান। মৃত্যুর ১ ঘণ্টা আগেও পরিবারের সাথে ভিডিও কলের মাধ্যমে কথা হয় রফিকুলের।
ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপেজলার রঘুনাথপুর চালাপাড়া গ্রামে দরিদ্র আব্দুল খালেকের পুত্র ইউনুস আলীও নিহত হন এই সড়ক দুর্ঘটনায় । মৃত্যুর একদিন আগে গত মঙ্গলবার বিকেলে শেষবারের মতো স্ত্রী তাসলিমার সাথে কথা বলেছিলেন সৌদি আরবে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ইউনুস আলী।
ইউনুস আলীর মৃত্যুর খবর প্রচারিত হলে গ্রামটিতে শোকের ছায়া নেমে আসে। পুত্র শোকে বৃদ্ধ পিতা-মাতা বাকরুদ্ধ। শাহাদত, সুমাইয়া ও মারিয়া নামের ৬ মাসের তিন সন্তান রয়েছে নিহত ইউনুস আলীর। স্বামীকে হারিয়ে স্ত্রী তাসলিমা খাতুন এখন পাগলপ্রায়।
নিহতের পরিবার সূত্রে জানা গেছে, ইউনুস আলী ভ্যান-রিকশা চালিয়ে ও অন্যের কাজ করে সংসার চালাতেন। বাড়ি ভিটাসহ ৫ কাঠা জমি ছিল তার। দুই কাঠা জমি বিক্রি করে ও ৫ লাখ টাকা দাদন নিয়ে এক মাস পূর্বে একটি কোম্পানির ভিসায় সৌদি আরব গিয়েছিলেন।
এক মাস দুই দিন হয়েছে সৌদি আরব গিয়েছিল আমার স্বামী। বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন নিহত ইউনুস আলীর স্ত্রী তাসলিমা খাতুন। তিনি বলেন, পৃথিবীতে আমার সব শেষ, এখন আমার এতিম সন্তানদের কে দেখবে? যে জমিটুকু ছিল বিক্রি করে ও ৫ লাখ টাকা সুদের ঋণের বোঝা নিয়ে বিদেশ গিয়েছিল। আমার স্বামীর লাশটা আনার ব্যবস্থা করে দিন আপনারা।
নিহতের চাচাতো ভাই ইউসুফ আলী বলেন, চার বোন এক ভাইয়ের মধ্যে একমাত্র উপার্জনক্ষম ছিল ইউনুস আলী। একেবারেই হতদরিদ্র পরিবার। অন্যের কাজ করে সংসার চালাতো। বিদেশে গিয়ে আয় করে ঋণের টাকা পরিশোধ করার কথাছিল। এখন সবই শেষ।
নিহতদের মধ্যে আরেকজন কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলার বাহাদিয়া গ্রামের গিয়াস উদ্দিনের ছেলে জুয়েল। গত শুক্রবার জুয়েলের মৃত্যুর সংবাদ পরিবারের কাছে পৌঁছলে তার পরিবারে শোকের ছায়া নেমে আসে।
জুয়েলের স্ত্রী নাজমা বলেন, নুসরাত জাহান জ্যোতি (৯) ও ইসরাত জাহান ইভা (৫) নামে তার দুই কন্যাসন্তান রয়েছে।বাপের বাড়ি থেকে ধারদেনা করে ৩লাখ ৭০ হাজার টাকা সংগ্রহ করে তার স্বামীকে সৌদি আরবে পাঠান।স্বামীর মৃত্যুতে তিনি দুই কন্যাসন্তান নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।
তিনি আরও জানান, কাজে যাওয়ার আগে বন্ধুর মুঠোফোনে তার স্বামী তাকে বলেন, কাজে যাচ্ছি। জ্যোতি ও ইভাকে দেখে রেখ। এটাই হলো স্বামীর সঙ্গে আমার শেষ কথা।
জুয়েলের পিতা গিয়াস উদ্দিন বলেন, দুই কন্যা সন্তানের দিকে চেয়ে অনেক কষ্ট করে ধারদেনা করে টাকা সংগ্রহ করে একটু সুখের আশায় সে বিদেশে গেছে। সুখ আর তার কপালে সইল না।তার স্ত্রী ও দুই কন্যা সন্তানের ভবিষ্যত কি হবে তা নিয়ে তিনি হতাশায় ভুগছেন।
উল্লেখ্য, গেলো বুধবার ১ মে সৌদি আরবের পূর্বাঞ্চলীয় শহর দাম্মাম থেকে রাজধানীর রিয়াদ হয়ে মদিনায় কর্মস্হলে যাওয়ার পথে রিয়াদ থেকে প্রায় ১৮০ কিলোমিটার ও শাকরা শহর হতে ২০ কিলোমিটার দূরে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় আল হাবিব কোম্পানি ফর ট্রেডিং কমার্সিয়াল কন্ট্রাক্টস লি. এর ১৭ জন শ্রমিক হতাহত হন । তার মধ্যে দুর্ঘটনাস্হলেই নিহত হয়েছেন ১০ জন । দুজনের অবস্হা এখনও আশঙ্কাজনক ।