নিজস্ব প্রতিবেদক | বর্তমানকণ্ঠ ডটকম:
শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে/ অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন/ তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল/ হৃদয়ে লাগিল দোলা/ জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার সকল দুয়ার খোলা/ কে রোধে তাঁহার বজ্রকণ্ঠ বাণী?/ গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শুনালেন তাঁর অমর কবিতাখানি/এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম/এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম/সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের…
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণকে কবিতার অক্ষরে কবি নির্মলেন্দু গুণ এভাবেই অমর করে তুলেছেন। হাজার বছর ধরে বাঙালির স্বাধীনতার যে স্পৃহা তারই মূর্ত ও দীপ্ত প্রকাশ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক এই ভাষণ। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে সারা দেশ থেকে আসা স্বাধীনতাকাক্সক্ষী লাখ লাখ অধীর জনতার সামনে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন মুক্তির অমিতবাণী। ১৯ মিনিটের ভাষণের প্রতি ছত্র, পঙ্ক্তি আর শব্দে দীপ্তকণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছে নিপীড়িত, বঞ্চিত, শোষিত জনগোষ্ঠীর আশা-স্বপ্নের বয়ান। বাঙালির স্বাধীনতার বীজ উপ্ত হয়েছিল এ ভাষণের মধ্য দিয়েই।
বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের ৪৮তম বর্ষপূর্তি আজ। বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের অনবদ্য এই ভাষণটি এখন বিশ্বের ঐতিহ্য। ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর এটি ঠাঁই পায় জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কোর ‘বিশ্ব ঐতিহ্য দলিল’ হিসেবে। সংস্থাটি তাদের ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারে’ অন্তর্ভুক্ত করে বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি।
রাজনৈতিক ঐতিহাসিকরা, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে ইতিহাসের ম্যাগনাকার্টা বা মহাসনদ বলেন। আব্রাহাম লিংকনের গেটিসবার্গের ভাষণের সঙ্গেও অনেকে তুলনা করেন অনন্য এ ভাষণকে। মহাকাব্যিক এ ভাষণে বঙ্গবন্ধু একেবারে লোকভাষায় শব্দের পর শব্দ গেঁথে উচ্চারণ করে যান মুক্তির বীজমন্ত্র। বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ ৭ মার্চের ভাষণের পর বাঙালির মুক্তির চেতনা উত্তুঙ্গস্পর্শী হয়। এ ভাষণে তিনি মুক্তিযুদ্ধের দিক-নির্দেশনা দিয়েছিলেন। এর ১৯ দিনের মাথায় পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী বাংলার সাধারণ নিরস্ত্র জনগণের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। শুরু করে ইতিহাসের নির্মমতম গণহত্যা। পাল্টা প্রতিরোধে শুরু হয় বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ। নয় মাসের যুদ্ধে ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে’ বিশ্বের বুকে জন্ম নেয় স্বাধীন ভূখণ্ড বাংলাদেশ।
মুক্তিযুদ্ধ গবেষক মফিদুল হক বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণ সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেছেন, ‘৭ মার্চের ভাষণে প্রতিরোধ আন্দোলনের এই লোকায়ত রূপ মেলে ধরবার পাশাপাশি প্রত্যাঘাতের ডাক এমন এক লোকভাষায় ব্যক্ত করলেন বঙ্গবন্ধু যে তিনি উন্নীত হলেন অনন্য লোকনায়কের ভূমিকায়, যার তুলনীয় নেতৃত্ব জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের কাফেলায় বিশেষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। বাংলার লোকঐতিহ্য ও জীবনধারার গভীর থেকে উঠে আসা ব্যক্তি হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন জাতির অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের নেতৃভূমিকায়। জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে তিনি যে কতটা সার্থক হয়ে উঠেছিলেন তার পরিস্ফুটন ঘটেছিল সংকটময় মার্চ মাসে তার অবস্থান ও ভূমিকা এবং ৭ মার্চের ভাষণের মধ্য দিয়ে।’
কিউবার অবিসংবাদিত নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো এ ভাষণ নিয়ে বলেছেন, ‘৭ মার্চের শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ শুধু ভাষণ নয়, এটি একটি অনন্য রণকৌশলের দলিল।’ বিখ্যাত নিউজ উইক সাময়িকী এ ভাষণ নিয়ে প্রকাশ করে, ‘দ্য পোয়েট অব পলিটিক্স’ নিবন্ধ। সেখানে বলা হয়, ‘৭ মার্চের ভাষণ কেবল একটি ভাষণ নয় একটি অনন্য কবিতা। এই কবিতার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু রাজনীতির কবি হিসেবে স্বীকৃতি পান।’
১৯৪৭ সালে সাম্প্রদায়িকতা ও দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে গঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ২৩ বছরের আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালির জাতীয়তাবোধ ও জাতিরাষ্ট্র গঠনের যে ভিত রচিত হয় তারই চূড়ান্ত পর্যায় বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ। এরপর ছাত্র-কৃষক-শ্রমিকসহ সর্বস্তরের বাঙালি স্বাধীনতা অর্জনের জন্য মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করে। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ৯ মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী হয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় ছিনিয়ে আনে বাঙালি জাতি। এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে বিশ্ব মানচিত্রে জন্ম নেয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।
৮ মার্চ ১৯৭১ বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু মঞ্চে আসেন বিকেল ৩টা ২০ মিনিটে। ফাগুনের সূর্য তখনো মাথার ওপর। মঞ্চে আসার পর তিনি জনতার উদ্দেশ্যে হাত নাড়েন। তখন পুরো সোহরাওয়ার্দী উদ্যান লাখ লাখ বাঙালির কণ্ঠে ‘তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ, তোমার নেতা আমার নেতা শেখ মুজিব, শেখ মুজিব’ স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধু দরাজ গলায় তাঁর ভাষণ শুরু করেন, ‘ভাইয়েরা আমার, আজ দুঃখ-ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি।’ এরপর জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে বাংলা ও বাঙালির স্বাধীনতার মহাকাব্যের কবি ঘোষণা করেন-‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
মাত্র ১৯ মিনিটের ভাষণে বঙ্গবন্ধু ইতিহাসের পুরো ক্যানভাস তুলে ধরেন। তিনি তাঁর ভাষণে সামরিক আইন প্রত্যাহার, জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর, গোলাগুলি ও হত্যা বন্ধ করে সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়া এবং বিভিন্ন স্থানের হত্যাকাণ্ডের তদন্তে বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠনের দাবি জানান।
বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘ভাইয়েরা আমার, আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না, মানুষের অধিকার চাই। প্রধানমন্ত্রিত্বের লোভ দেখিয়ে আমাকে নিতে পারেনি। ফাঁসির কাষ্টে ঝুলিয়ে দিতে পারেনি। আপনারা রক্ত দিয়ে আমাকে ষড়যন্ত্র-মামলা থেকে মুক্ত করে এনেছিলেন। সেদিন এই রেসকোর্সে আমি বলেছিলাম, রক্তের ঋণ আমি রক্ত দিয়ে শোধ করব। আজো আমি রক্ত দিয়েই রক্তের ঋণ শোধ করতে প্রস্তুত।’
বঙ্গবন্ধুর ভাষণের সর্বশেষ দুটি বাক্য, যা পরবর্তীতে বাঙালির স্বাধীনতার চূড়ান্ত লড়াইয়ের দিক-নির্দেশনা ও প্রেরণার হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয়বাংলা’।
কর্মসূচি
ঐতিহাসিক ৭ মার্চ উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। দিবসটি যথাযথ মর্যাদায় পালনের জন্য আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এসব কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে- ভোর ৬টা ৩০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু ভবন ও দলীয় কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন, সকাল ৭টায় বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন। এ ছাড়া বিকাল ৩টায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হবে আলোচনা সভা। এতে সভাপতিত্ব করবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।