বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০১:৫৬ পূর্বাহ্ন

পরিকল্পিত নগরায়নঃ ছোট ছোট নদ-নদী গুলো উদ্ধার করা জরুরি

মোশাররফ হোসেন মুসা / ৭৪ পাঠক
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০১:৫৬ পূর্বাহ্ন

বিভিন্ন মিডিয়ায় একই খবর বার বার প্রচারের কারণে আমাদের বিশ্বাস জন্মেছে যে, শহরের লোকেরা শুধু নদ-নদী-খাল-বিল দখল করে নিচ্ছে ; কিন্তু এই দখল প্রক্রিয়া গ্রাম পর্যন্ত কীভাবে বিস্তৃত হয়ে গেছে , তা আমরা খোঁজ রাখি না।

বাংলাদেশে একসময় সহস্রাধিক নদ-নদী জালের মতো ছড়িয়ে ছিল। কিন্তু বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের গাফিলতির কারণে ভূমিদস্যুরা সেগুলো দখলে নিয়ে গেছে। পুর্বে যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল নদীকেন্দ্রিক। সেকারণে নদীবন্দরকে ঘিরে শহর গড়ে ওঠে। ঢাকার চারদিকে বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালু নদীর সঙ্গে যুক্ত ছিল অনেকগুলো খাল। স্বাভাবিক কারণে নৌপথে মালামাল পরিবহনের সুবিধার্থে মোঘলরা ঢাকায় শহর প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী হয়ে ওঠে। শুধু ঢাকা কেন, সমস্ত শহরের মাঝ দিয়ে অথবা পাশ দিয়ে কোনো না কোনো নদী বয়ে গেছে। পাবনা শহরের ইছামতি, ময়মনসিংহ শহরের ব্রহ্মপুত্র, বগুড়া শহরের করতোয়া, কুষ্টিয়া শহরের গড়াই, যশোর শহরের ভৈরব উদাহরণ হতে পারে। আর বরিশালকে তো বলা হয়, নদ-নদী-খাল এই তিনে বরিশাল।

বাংলাদেশে বৃহৎ নদী হিসেবে খ্যাত পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, কর্ণফুলী, শীতলক্ষ্যা, গোমতি ইত্যাদি। এই নদীগুলোর সঙ্গে সহস্রাধিক ছোট ছোট নদ-নদীর সংযোগ ছিল। সেজন্য বলা হয়, নদী বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে। পরিতাপের বিষয়, বহু ছোট নদীর উৎসমুখ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় নদীগুলো পরিত্যক্ত ও ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। বহু নদী ভরাট করে আবাসন শিল্প গড়ে তোলা হয়েছে।

একসময় ঈশ্বরদীর পাশ দিয়ে কমলা নদী প্রবাহিত ছিল। এই নদীটি কীভাবে হারিয়ে গেল সেটাই আজকের নিবন্ধের মুল উদ্দেশ্য। শুধু তাই নয়, এই নদীটির মৃত কাহিনীই বলে দিবে অন্যান্য নদীগুলো কীভাবে মৃত্যু ঘটেছে। বাংলাদেশে বর্তমানে ৪৩ টি মন্ত্রণালয় রয়েছে। দেশের সমস্ত সম্পত্তি কোনো না কোনো মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ।

সবার উপরে রয়েছে ভূমি মন্ত্রণালয়। এই মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমেই জমি হুকুম দখল করা হয়। যতদুর জানা যায়, পাকশি-বাঘৈল এলাকার একজন রাজার কন্যার নাম ছিল কমলা। তার নামানুসারেই কমলানদী। কমলা নদীটি পদ্মা নদীর সাড়া এলাকা থেকে উৎপত্তি হয়ে স্কুল পাড়া দিয়ে রেলগেটের উত্তর পাশ হয়ে কৃষি ফার্মের ভিতর দিয়ে অরনকোলার দোহায় গিয়ে মিশে।

তারপর মুলাডুলির কৃষি ফার্মের ভিতর দিয়ে বড়াই গ্রাম উপজেলার রাজাপুর হাটের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে রামেশ্বরপুর দুর্গাপুর গ্রামের পাশ দিয়ে গারফা চিকনাই নদীতে গিয়ে মিশেছে। চিকনাই নদীটি চলনবিলে গিয়ে শেষ হয়। যে কোনো সরকার উন্নয়নের আগে বৃহৎ পরিকল্পনা গ্রহণ করে। বৃটিশ ও পাকিস্তান আমলে কিছুটা হলেও প্ল্যান ছিল। বৃটিশ রেললাইন নির্মাণ করার সময় কমলা নদীর প্রবাহকে সামনে রেখে ঈশ্বরদী রেলগেটের কাছে বেশ প্রশস্ত একটি রেল সাকো নির্মাণ করে।
পাকিস্তান আমলে আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের জন্য জমি হুকুম দখল করা হয়। তখন কৃষি মন্ত্রণালয় কমলা নদীর প্রবাহের জন্য একটি খাল নির্মাণ করে, যা সবুজকুঁড়ি কিন্ডারগার্টেন থেকে অরনকোলা হাট পর্যন্ত এখনো দৃশ্যমান রয়েছে।

১৯৭৭-১৯৭৮ সালেও দেখা গেছে পশ্চিম টেংরি স্কুল পাড়া থেকে রেলসাকোর নীচ দিয়ে প্রচন্ড গতিতে পানি প্রবাহিত হতো। বাচ্চু আর্টের বাড়ির কাছে সাতারসম পানি থাকতো সব সময়। তারপর পৌর চেয়ারম্যান (মেয়র)দের গাফিলতি ও ভুমি মন্ত্রণালয়ের উদাসীনতার কারণে নদীটি প্রাণ হারায়। উল্লেখ্য, সাঁড়া ইউনিয়ন, ঈশ্বরদী পৌরসভা, মুলাডুলি ইউনিয়ন সহ যেসব এলাকা দিয়ে নদীটি প্রবাহিত হয়েছে, সেসব এলাকার জমির মালিক ভূমি মন্ত্রণালয়। স্থানীয় পর্যায়ে সেসব জমি রক্ষার জন্য এসি(ল্যান্ড), ইউএনও, এডিসি, ডিসি পদাধিকারী সরকারি কর্মকর্তারা রয়েছেন। সেজন্য দেখা যায়, পাবনাতে কোনো নতুন ডিসি বদলি হয়ে এসেই প্রথমে ঘোষণা দেন- “আমার প্রথম দায়িত্ব হলো ইছামতিকে রক্ষা করা”। কিন্তু কোনো ইউএনও কি বলেছেন,যে তিনি কমলা নদী উদ্ধার করবেন? ঈশ্বরদীবাসীর সৌভাগ্য যে, একজন পূর্ণ মন্ত্রী পেয়েছিলেন। তিনি হলেন ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ ডিলু। তাঁর হাতে সমগ্র দেশের জমি রক্ষার দায়িত্ব ছিল। তিনি কি কখনো কমলা নদীর নাম মুখে এনেছেন? কঠিন সত্য কথা হলো, তার বাড়ির আঙ্গিনার ফুলের বাগান বিস্তৃত করতে গিয়ে কমলা নদীটির জায়গা যতটুকু ছিল তা সংকুচিত হয়ে পড়ে। বর্তমানে খালটি পাঁচফুট প্রশস্ত ড্রেনে পরিণত হয়েছে। অথচ তাঁর সামান্য টেলিফোনে নদীটির অস্তিত্ব রক্ষার্থে জমি হুকুম দখল করা সম্ভব ছিল। বর্তমানে খালটির উভয় পার্শ্বে বহু হাইরাইজ বিল্ডিং নির্মাণ করা হয়েছে/হচ্ছে। নদীটির উৎসমুখ বহু আগেই ভরাট করে বাড়িঘর নির্মাণ করা হয়েছে। ঈশ্বরদী শহর ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

নতুন নতুন বিল্ডিং নির্মাণ করা হচ্ছে। যোগাযোগ ও বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের কারণে এলাকাটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ২০৫০ সালের আগে কিংবা পরে সমগ্র দেশটি নগরায়ন হয়ে যাবে । সরকারও ‘Perspective Plan Of Bangladesh 2021-2041’ নামক প্রস্তাবনায় বিষয়টি স্বীকার করে নিয়েছে। নগর হলো সভ্যতার স্থায়ী প্রতিষ্ঠান। এ সভ্যতা দীর্ঘকাল স্থায়ী হবে। সেজন্য মহাপরিকল্পনার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কিন্তু ঈশ্বরদীর পয়ঃনিষ্কাশন ও জলাবদ্ধতা কীভাবে দুর হবে, কিভাবে এর স্থায়ী সমাধান হবে, নির্বাচিত প্রতিনিধিরা ভাবছেন কি? অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, তারা কেউই নিজেদেরকে দায়িত্বশীল ব্যক্তি মনে করেন না, তারা নিজেদেরকে চাকুরীজীবী মনে করেন; অথবা রাজনীতিতে টিকে থাকার জন্য একটি পদ থাকার দরকার, সে হিসেবে নির্বাচিত হচ্ছেন। এমতাবস্থায় সচেতন মহলের দায়িত্ব রয়েছে, পরিবেশ বান্ধব পরিকল্পিত নগর ও নগরায়নের স্বার্থে দেশের ছোট ছোট নদীগুলো উদ্ধারের জন্য সোচ্চার হওয়া।

লেখকঃ গণতন্ত্রায়ন ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার বিষয়ক গবেষক।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *