শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০১:১৩ পূর্বাহ্ন

প্রবাসে মায়ের ভাষার পিপাসা অত:পর

সৈয়দ মুন্তাছির রিমন / ৮৫ পাঠক
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০১:১৩ পূর্বাহ্ন

পৃথিবীর সবচেয়ে মধুর শব্দ হলো-মা। আর সন্তানের জন্য সবচেয়ে কষ্টের শিকার হয় মা। মায়ের গর্ভ ধারনের যন্ত্রণা পৃথিবীতে বিরল। মানব ইতিহাসে এই কষ্ট-যন্ত্রণা কোন সম্পর্কে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাই এই মাকে নিয়ে রূশ কথাসাহিত্যিক মাক্সিম গোর্কি রচিত এক কালজয়ী উপন্যাস মা। যা ১৯০৬ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। রুশ ভাষায় লিখিত এই উপন্যাসটি পরবর্তী একশত বছরে সারাবিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। উপন্যাসটি বিপ্লবী শ্রমিক আন্দোলনের পটভূমিকায় রচিত এবং উপন্যাসের প্রধান দুটি চরিত্র হল প্যাভেল ও তার মা।

আবার বাংলাদেশের কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক আনিসুল হক রচিত একটি উপন্যাস মা। বইটি ২০০৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা মাগফার আহমেদ চৌধুরী আজাদ ও তার মায়ের জীবনের সত্য ঘটনা নিয়ে রচিত এই উপন্যাসটির আবেদন মর্মস্পর্শী। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস গুলোর মধ্যে এটির স্থান অন্যতম। এই মাকে নিয়ে আমাদের বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম কবিতা লিখতে বাদ যায়নি। কিন্তু পৃথিবীর সংবিধানে মায়ের মতো এতোটা ত্যাগ স্বীকার কেউ করেনি আর করবে-ই না।

কিন্ত এই মায়ের নিজস্ব একটি নিদিষ্ট মুখের বুলি আছে। যে বুলির নাম দিয়েছি আমরা মায়ের ভাষা।

মানব জীবনে মনের ভাব প্রকাশের সর্বশ্রেষ্ট মাধ্যম হলো মুখের ভাষা। মুখের ভাষার আরেকটি নাম আছে তা হলো বাকশক্তি। প্রথম উচ্চারিত শব্দ আর প্রথম ভাষা এক কথা নয়। যখন মনের ভাব মুখে প্রকাশ শুরু হলো, সেই সময়টি কবে? সেই ভাষাটি কোনটি? আমরা সাধারণ ভাবে ধারনা করতে পারি এই শক্তি বা ভাষার আদি রুপ হলো হযরত আদম (আ:)। তিনি যখন পবিত্র আরাফাতের ময়দানে দাড়িয়ে মহান আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করেন তখন নিশ্চিত সেখানে ভাষা ছিল। যে ভাষার মাধ্যমে প্রভুর কাছে ক্ষমা চেয়েছেন।

এই মুখের ভাষা কি ছিল? হ্যা-এই মুখের ভাষা আরবি ভাষা। যে ভাষা পবিত্র কোরআনের ভাষা। পরকালেও সে ভাষা বিদ্যমান থাকবে। অ্যাথনোলোগের সর্বশেষ তথ্যমতে, পৃথিবীতে মোট সাত হাজার ৯৯টি ভাষা বর্তমানে চলমান। ভাষার শুরুটা কিভাবে হয়েছে, কিভাবে এতগুলো ভাষার জন্ম হয়েছে, কিভাবে ভাষার ক্রমবিকাশ ঘটেছে, এ নিয়ে ভাষাবিজ্ঞানীদের বিরোধের অন্ত নেই। ১৮৬৬ সালে প্যারিসের ভাষাতাত্ত্বিক সমিতি (Linguistic Society of Paris) ভাষার উৎপত্তি বিষয়ে এত জটিলতা থাকার কারণেই ভাষার উৎস সংক্রান্ত যেকোনো গবেষণাপত্র পাঠে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।

আর ভাষার বৈশিষ্ট হলো মানব জন্মসূত্রে মায়ের কাছ থেকে যে ভাষা অর্জন করে তাই-ই মায়ের ভাষা বা মাতৃভাষা। যেহেতু আমি বাংলাদেশী বা বাঙ্গালী তাই আমার মায়ের ভাষা বাংলা। ভাষা প্রধানত দুই প্রকার।

যথাঃ (ক) কথ্য ভাষা বা মুখের ভাষা ও (খ) লেখ্য ভাষা বা লিখিত ভাষা। এই কথ্য ভাষাকে দুই ভাগে বিভক্ত করতে পারি একটি আঞ্চলিক অন্যটি শুদ্ধ বা রাষ্ট্রভাষা। তাই আমারও ভাষা বাংলা। সত্যিকার ভাবে যতদিন বাংলার নদী-সাগর আর প্রকৃতির মাঝে মিশে জীবন কাটিয়েছি ততদিন এই ভাষার মুল্য অনুধাবন করতে পারিনি। আর সেটি স্বাধীন রাষ্ট্রে কেউ ততটা করেনি। যদি কেউ অক্ষর জ্ঞান সম্পুর্ন হয় তাহলে পরিবেশগত ও চেষ্টায় ভাষার দখল চলে আছে। কারও অক্ষর জ্ঞান না থাকলেও বাংলা ভাষায় কথা বলতে পারে এবং মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে।

মোদের গৌরব মোদের আশা,আ-মরি বাংলাভাষা-অতুল প্রসাদ সেনের এই উক্তির যথেষ্ট স্বার্থকতা রয়েছে।

কেননা বাংলাদেশই একমাত্র রাষ্ট্র যার রয়েছে মাতৃভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা অধিকার আদায়ের জন্য বুকের তাজা রক্ত দেয়ার গৌরবময় ইতিহাস। শহীদ শফিক, রফিক, সালাম, বরকত, জব্বারসহ অনেকের মাতৃভাষার ডাকে সর্বপ্রথম এদেশের মানুষের নিদ্রা যেমন ভেঙ্গেছে, তেমনি ওরা ৬দফা আর ১১ দফা দাবির শপথে ও পরবর্তীকালে স্বাধীনতা সংগ্রামে বায়ান্নর পথ বেয়ে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ বাঙ্গালীর জীবনে নিঃসন্দেহে শ্রেষ্ট ঘটনা। ১৭৫৭ থেকে ১৯৪৭ সালের মোট এই ১৯০ বছর দুর্দান্ত প্রতাপ নিয়ে এদেশকে শাসন-শোষণ করা হয়। ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগষ্ট ভারতবর্ষকে পাকিস্তান ও হিন্দুস্থান বানিয়ে ধর্মভিত্তিক দুটি রাষ্ট্রে বিভক্ত করে দেয়। ধর্মকে প্রাধান্য দিয়েই সেদিন অভ্যূদয় ঘটে নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের। এ নতুন রাষ্ট্রের একটি প্রদেশ হলো পশ্চিম পাকিস্তান এবং অন্যটি পূর্ব পাকিস্তান। আর তৎকালীন সরকার ৫৬ ভাগ মানুষের মুখের ভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে অস্বীকৃতি দেয়।

আর তখন শুরু হয় সংগ্রাম ও আন্দোলন। এ আন্দোলনে নিহতের স্মরণে মাহবুব উল আলম চৌধুরী “কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি” কবিতায় লিখেছেন-
“আজ আমি শোকে বিহবল নই
আজ আমি ক্রোধে উন্মত্ত নই
আজ আমি প্রতিজ্ঞায় অবিচল ।
তাদের ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি
যারা আমার অসংখ্য ভাইবোনকে
নির্বিচারে হত্যা করেছে।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল ছাত্ররা হাতের মুঠোয় মৃত্যু নিয়ে স্বপ্নের পথে পা বাড়ায় আর তাদের পদচিহ্নে প্রতিনিয়ত জন্ম হয় নতুন ভোর। যে ভোরের সূর্যোদয়ে বিলীন হয় পশ্চিম পাকিস্তানের দুঃশাসন। এ ভাষা প্রতিষ্ঠার দাবিতে তখন উত্তাল ছিল বিভিন্ন বিভাগীয় শহর। এমনকি সারাদেশের ভাষাপ্রেমী জনতা।

ভাষার জন্য প্রাণ দেয়ার এ সংগ্রামী ইতিহাস সারাবিশ্বের মানুষ জানে। ২১ ফেব্রুয়ারি আমাদের মহান মাতৃভাষা একুশে মাতৃভাষা দিবস। এই দিনে প্রতিটি বাঙালি স্ব-শ্রদ্ধচিত্রে স্মরণ করে তার সূর্য সৈনিকদের। ১৯৯৯ সালের নভেম্বর ইউনেসকো ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। প্রতিটি বাংলাদেশি নাগরিকের মতোই বিশ্বের প্রতিটি মানুষও গভীর ভাবে স্মরণ করে অমর শহীদদের কথা। পৃথিবীর প্রায় ২৫ কোটি মানুষের মাতৃভাষা বাংলা হলেও একমাত্র স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্র ভাষা বাংলা। বাংলা ভাষায় রয়েছে অফুরন্ত শক্তি, প্রাণ সম্পদ ও সম্ভাবনা। তখন এই সম্ভবনাময় ভাষার বাস্তবতা বুঝতে পারলাম যখন নিজের মাতৃভুমি ছেড়ে পরবাসে যাত্রা করলাম।

ইতিহাসের পাতা পড়ে দরদ আর ভালবাসা নেয়া আর বাস্তবতার সম্মুখে দাড়িয়ে প্রতিকুল পরিবেশ মোকাবেলা ভিন্ন মাত্র যোগ করে। দেশ ছাড়ার পর তখনো বুঝিনি মায়ের ভাষার গুরুত্ব। পরবাসে নিজের কাজ শেষে সাথে থাকা বন্ধ-বান্ধবের আড্ডায় কেটে যেত সময়। তখনো বুঝিনি তার বাস্তবতা। যে বাস্তবতা হৃদয়টাকে এতোটা নাড়া দিবে? তারপর যার যার গন্তব্যে চলে গেলো সবাই। আমার নিদিষ্ট গন্তব্য ইউরোপের একটি দেশ লাটভিয়ায় অবস্থান করলাম। এই দেশে তাদের রাষ্ট্র ভাষা লাটভিয়া ও অফিসিয়্যাল ভাষা লাটভিয়া। আর এখানকার অধিবাসীরা দুইটি ভাগে বিভক্ত অর্ধেক রুশ বা রাশিয়ান ভাষায় কথা বলে বাকীরা লাটভিয়ান ভাষায় কথা বলে। কিন্তু এদেশের জনগণের সবচেয়ে বড়গুণ হলো এরা সবাই ইংরেজী বুঝে ও কথা বলতে এবং বুঝাতে পারে। এমন কি ভড্ড মাতাল কিংবা বয়স্ক লোক ইংরেজী ভাষা শুনলে কোন খারপ্ন ও দ্বীধাদ্বন্দ্ব ছাড়া সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দেয়। তখন বাস্তবতার নিরিখে ইংরেজী ভাষা হয়ে উঠে আমার বেঁচে থাকা, সামাজিক, অফিসিয়্যাল ও একে-অন্যের সাথে মত-বিনিময়ের প্রধান চাবি-কাটি। মাঝে মধ্যে দুই এক হিন্দি ও উর্দ ভাষার মানুষের সাথে দেখা হলে কথোপতনে নিজেকে হালকা লাগতো।

কিন্তু এদের সাথে ইংরেজী ভাষায় বেশি উচ্চারিত হতো। এভাবে ধীরে ধীরে এক বছর কেটে গেলো। মোবাইল ফোনে দেশে পরিবারের সাথে কথা হয় কিন্তু তীলে তীলে হৃদয়ে ভাবের দারিদ্র্যতা বাসা বাধলো। মনে মনে যেখানে-ই যাই একজন বাংলাদেশীর খুঁজ করি। কিন্তু দেখা মিলে না। ডায়েরীতে মনের কথা লিখতে থাকি। ততেও মনের ব্যথা কমে না। বরং বাড়তে থাকে। একদিন রিগা পুরাতন শহরে জাপানী রেষ্টুরেন্টে খাবার খেতে গিয়ে ইংরেজী ভাষায় কথা বলতে চোখের ভাষায় একে অন্যকে বলে উঠি আপনি বাংলাদেশী। তারপর কি যে আনন্দ তা বলার ভাষা নেই। তিনি লাটভিয়ার একমাত্র বাংলাদেশী আরাফাত সুমন। যার বাড়ী নোয়খালী।

তারপর এই দিন-ই তিনি তার বাসায় নিয়ে গেলেন। সারারাত গল্প আর খাবারে খেয়ে পাড় করে দিলাম। পরদিন কেউ কোথাও যাওয়া হয়নি। এভাবে প্রতি সপ্তাহে তার বাসায় আড্ডা হতো। এমন করে আরো ছয় মাস কেটে গেলো। কিন্তু আমার ভাবের দারিদ্র্যতা কমেনি। আরো একদিন সেখানকার সরকারী একটি কাজে তারেক আহমদের সাথে দেখা। তাকে দেখে চমকে গেলাম। তার বাড়ী হবিগঞ্জে। সেদিন পুরো দিন দু‘জনে এক সাথে কাটালাম। তার সাথেও প্রায় সময় দিনচুক্তি ঘুরে কাটিয়ে দিতাম। এবারও ভাবের পিপাসা মিটেনি। আরো ছয় মাস পাড় হলো। এবার কিন্তু ভিন্ন একটি দ্বার উন্মোচন হলো। আমি ছুটির দিনে বাসায় একা হঠাং নিচের প্রহরি এসে আমাকে ডাক দিলো অন্য প্লাটে এক বিনদেশী লোক এসেছে তার সংবাদ দিলো। সে ইংরেজীতে কথা বলছে। সমস্যা বাধে প্রহরি ইংরেজী জানতো কম। তাকে সে বুঝাতে পারছে না। তাই আমাকে যাওয়ার অনুরোধ করলো। আর প্রহরি বিভিন্ন সময় কোন সমস্যায় পড়লে সাথে সাথে আমাকে ডেকে নেয়া তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। তাই আমার কাছে সেটি স্বাভাবিক নিয়মে নিচে গিয়ে আগত ব্যক্তির সাথে পরিচিত হলাম। তাকে কোথায় থেকে এসে প্রশ্ন করার সাথে সাথে বা উচ্চারণ করতেই কান্না জড়িত কন্ঠে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। ভাই আপনি বাংলাদেশি। আমি হ্যা সূচক বাক্য ব্যবহার করে তাকে আমার রুমে নিয়ে গেলাম।

আর এই মানুষটি হলো মো: সিদ্দিকুর রাহমান। সে সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার লাউতা ইউনিয়নের বাউরভাগ গ্রামের অধিবাসী। এখানে দুই মাস হয়েছে উচ্চ শিক্ষার ভিসা নিয়ে এসেছে। আর আবাসস্থল পরিবর্তন সংক্রান্ত জটিলতায় পড়ে আমার সাথে দেখা। সময়ের তালে তালে দুজনার ভালোবাসা আর আন্তরিকায় আপন হয়ে তার নিজস্ব ফ্লাট ফেলে আমার রুমে এক সাথে আড্ডায় কত শত রাত কেটে যায় বলতে পারিনি। তার সম্পর্কে জানতে গিয়ে তার ভিতরের ঘুমন্ত বিস্ফোরনটি লক্ষ্য করলাম। সে ছাত্র রাজনীতি ও সংগঠনে বিচরন করে আসা প্রতিভা। তবে এর বাহিরে আরেকটি প্রতিভাকে নিজ দায়িত্বে জাগিয়ে দিলাম। সে আজ ইউরোপে প্রতিষ্টিত সাংবাদিক। স্পেনে বাংলা ভাষার গণমাধ্যমের আগামীর উদিয়মান নেতৃত্ব। তার প্রতিভাকে জাগাতে গিয়ে কখন যে নিজের ভাবের দারিদ্র্যতা হারিয়ে যায় বুঝতে পারিনি তখন। আমাদের মায়ের ভাষা বা আঞ্চলিকতায় ভাব বিনিময়ের মাধ্যমে নিজের দু:খ, কষ্ট ও যন্ত্রণা লাগব হয়ে যায়। নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পাই।

কিছুদিন পর আবার আমরা বিভক্ত হয়ে যাই। আমি ফ্রান্সের আলো-বাতাসে নিজেকে হারিয়ে ফেলি। কিন্তু এখানে অধিকাংশ বাঙ্গালীর দেখা মিললেও আবার ভাবের দারিদ্র্যতা দেখা দেয়। ফরাসী ভাষা শিক্ষার পরও সেই বাংলা ভাষা বা মায়ের ভাষার্চ্চার খাদটি খুঁজে পাইনা। মনের ভিতর নানান চিন্তা বাধতে শুরু করে।

এভাবে চলতে থাকলে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম বাংলাদেশ নামক একটি রাষ্ট্রের ভাষা বাংলা ভাষাকে চিরতরে ভুলে যাবে বলে চিন্তা হয়। সেদিন ইউরোপ বাংলাদেশ প্রেসক্লাবের যুগ্নসাধারণ সম্পাদক ফরিদ আহমেদ পাটোয়ারী ভাইয়ের সাথে দীর্ঘ সময় কথা বলে তার দীর্ঘশ্বাসে তা ফুটে উঠে। ইদানিং প্রবাসে আগামীর প্রজন্ম বাংলা ভাষায় কথা বলতে পারছে শুনে তিনি এতোটা খুশি হয়েছেন যে তাকে এই ইউরোপের রাজত্ব দিলেও তিনি আনন্দ উপভোগ করতেন না। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম মায়ের ভাষা বাংলায় কথা বলতে, লিখতে পারছে। সেটি একজন অভিবাবকের সবচেয়ে গর্বের বিষয়। হ্যা, এরাই প্রবাসী ও অর্থযোদ্ধা। শুধু পরিবার আর পরিজন নিয়ে নয় দেশ ও দশের কথা ভাবতে থাকে। আর প্রবাসীর ভাবনাকে সম্মান জানাতে প্রয়োজনীয়তার কথা চিন্তা করে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ববোধ থেকে বাংলাদেশের প্রতিটি জাতীয়, আঞ্চলিক পত্রিকা তাদের অনলাইন ভার্সনে পরবাস কিংবা প্রবাস নামে নতুন অধ্যায় বা বিভাগ চালু করেছেন।

ইতিমধ্যে এই বাংলা বা মায়ের ভাষাকে শ্রদ্ধা ও সম্মান জানাতে আফ্রিকা, ইউরোপ, আমেরিকা এবং অষ্টেলিয়া মহাদেশের বিভিন্ন দেশের পাশাপাশি ফ্রান্সের তুলুজ শহরে স্থানীয়ভাবে বাংলাদেশি কমিউনিটি ও প্রসাশনের সহযোগীতায় শহীদ মিনার স্থাপন হয়েছে। এছাড়া প্যারিস শহরের কাছাকাছি সেন্টডেনিস এলাকায় আরেকটি শহীদ মিনার স্থাপন করার পরিকল্পনা গ্রহন করা হয়েছে। যা নিমার্ণের প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

সর্বোপরি কেবল আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির মধ্যে ভাষাকে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। মাতৃভাষা ও সাহিত্যের আরো শ্রীবৃদ্ধির জন্য বিদেশী সাহিত্যের গ্রন্থাদি অনুদিক, আধুনিক ইন্সটিটিউটের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

মাতৃভাষা কেবল শিক্ষার মাধ্যম ও অফিস আদালতের ভাষা হিসাবে নয়। আমাদের সৃজনশীল চেতনার মধ্যে বাংলা ভাষার সৌন্দর্য ও শক্তিকে স্বার্থকভাবে ব্যবহার করতে হলে ভাষা চর্চার ব্যাপক আকার সৃষ্টি করতে হবে। দেশের গ্রামে-গঞ্জে রয়েছে এক বিশাল ছাত্র সমাজ । যেখানে ভালো শিক্ষক নেই, লাইব্রেরী নেই, নেই কোচিং সেন্টার। এমন কি দেশের প্রতিটি উপজেলায় শহীদ মিনার গুলো অযত্নে আর অবহেলায় পড়ে গরু-ছাগল ও ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হয় তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। এই অবহেলিত স্থাপনা গুলোকে ছোট ছোট র্পাক হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা গ্রহন করা প্রয়োজন। যাতে সারা বছর শহীদ মিনার ও তার আশ-পাশ এলাকা গুলোতে দর্শনার্থীদের পদধুলিতে মুখরিত হয়ে উঠে ও প্রবীণদের আড্ডার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠে। যাতে আগামীর প্রজন্ম একটি বাসযোগ্য সুস্থ পরিবেশে খুঁজে পায়।

কথায় আছে কষ্টের ধন থাকে চিরকাল। সত্যিই এ ভাষা রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে। আমাদের জাগ্রত চেতনার মতোই যা অম্লান সেই মাতৃভাষার বিকাশে আরো কিছু করার আছে। কিন্তু আজো তার প্রকৃত স্বাদ ভোগ করতে পারিনি। আজো ভাষায় লিখতে গিয়ে লেখক, সাংবাদিক ও সাহিত্যিক নির্যাতন এবং হত্যা বা নিহত হয়েছেন। এক্ষেত্রে দেশে লোকজ বাঙ্গালি সংস্কৃতি বিকাশে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগেরও প্রয়োজন। প্রবাসের রঙিন সুখের আলোর মাঝেও মায়ের ভাষার প্রতি পিপাসা বা পিছুটান রয়ে যায়। যে পিপাসা কোন জলেও নিবারণ হয় না। এই পিপাসা হউক মায়ের ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মানের এক নিয়ামক শক্তি এ প্রত্যাশা রইলো।

লেখক : সাংগঠনিক সম্পাদক-ইউরোপ বাংলাদেশ প্রেসক্লাব-ফ্রান্স।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *