বিগত বছর গুলোতে শিশু-শিক্ষার্থীরা নিয়মিত স্কুলে আসা-যাওয়া ও খেলা-ধুলা করে ব্যস্ত সময় কাটালেও গত নয় মাস ধরে করোনা মহামারিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বিপাকে পড়েছে শিশু-শিক্ষার্থীরা। অন্য দিকে এই মরণঘাতী করোনা ভাইরাসের কারণে কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ীতে হতদরিদ্র পরিবারগুলোতে উপাজন কমে যাওয়ায় তাদের নিজ সন্তানদের শ্রম বিক্রিতে ঠেলে দিচ্ছেন। পরিবারের পাশাপাশি এক শ্রেণীর সুযোগ সন্ধানী ব্যবসায়ী ও প্রতিষ্টানের মালিকগন এরই সুযোগে কম পারিশ্রমিকে শিশু-শিক্ষার্থীদের দিয়ে চায়ের দোকান ফাইফরমায়েস খাটা, মুদি ও মাছের দোকানের সহকারী এবং বাদাম,তিলের খাজা,চানাচুরসহ নানা শ্রমে নিয়োজিত করেছেন।
দ্বিতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থী হাফিজুর রহমান। উপজেলার বিলুপ্ত ছিটমহল দাসিয়ারছড়ার বটতলা এলাকার ইজ্জত আলীর ছেলে। বাবা ইজ্জত আলী এক গরীব-অসহায় দিনমজুর। দুইভাইয়ের মধ্যেই হাফিজুর সবার বড়। বাবা-কোন রকমেই দিন মজুরের কাজ-কাম করে সংসার চালায়। ছেলের স্কুল বন্ধ থাকায় পরিবারের স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনতে পরিবারের লোকজন হাফিজুলকে উপজেলার বিলুপ্ত ছিটমহল দাসিয়ারছড়ার কালিরহাট বাজারে মোস্তাফিজুর রহমানের চায়ের দোকানে দৈনিক ১০০ টাকা মজুরীর বিনিময়ে কাজে নিয়োজিত করেন। দ্বিতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থী হাফিজুর প্রচন্ড শীতে ঠিকমত কথা বলতে পারছেন না। গাঁয়ে লাল রংয়ের হাফ-গেঞ্জি । পৌষের প্রচন্ড ঠান্ডায় কাঁপতেছে। তারপরেও কাঁপতে কাঁপতে খদ্দেরের হাতে তুলে দিচ্ছেন চায়ের কাপ।
হাফিজুর জানান, আমরা খুবেই গরীব। আমি কালিরহাট সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ি। করোনা চলছে তাই স্কুল বন্ধ । গত ১৫ দিন ধরে চায়ের দোকানে কাজ করছি। এখানে মালিক দুই বেলা খাওয়া-দাওয়া দেয়। সাথে দৈনিক ১০০ টাকা দেয়। আমার উপাজনের টাকা বাবার হাতে তুলে দেই। স্কুল খুললে স্কুলে যাবো।
অপর দিকে ৫ম শ্রেণী শিক্ষার্থী এরশাদুল। তার বাড়ী উপজেলার সীমান্তবর্তি নাওডাঙ্গা ইউনিয়নের কুরুষাফেরুষা গ্রামে। সে পূর্ব-কুরুষাফেরুষা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৫ম শ্রেণীর শিক্ষার্থী। চার ভাই, এক বোন। বড় দুই ভাইয়ের আলাদা সংসার। দুই ভাই,মা-বাবাসহ চার জনের সংসার। বাবাই সংসারের একমাত্র উপাজর্নক্ষম ব্যক্তি। বাবা মফিজল মানুষের বাড়ীতে দিনমজুরী কাজ-কাম করেই কোন রকমেই জীবন-যাপন করছেন। অভাব তাদের নিত্য সঙ্গী। এরশাদুল সবার ছোট। করোনায় স্কুল বন্ধ থাকায় একমাত্র ছোট ছেলে এরশাদুলকে সংসারের অভাব পুরন করতে পরিবার তাকে বাদাম বিক্রি করতে দিয়েছেন। শিশু বয়সেই এরশাদুল বাদামের ডালা ঘাঁড়ে নিয়ে বালারহাট বাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় বাদাম বিক্রি করেন। বাদাম বিক্রির আয় গড়ে দৈনিক ১৫০ থেকে ২০০ টাকা দিনমজুর বাবা মফিজলের হাতে তুলে দিচ্ছেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুললে যাবে কি না ,এমন প্রশ্নের উত্তরে এরশাদুল জানালেন স্কুল খুললে স্কুলে যাবো।
অন্য দিকে উপজেলার বালারহাট বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, বালারহাট বাজারে বাঁশের তৈরী কুলা বিক্রি করছেন বালারহাট সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৫ম শ্রেণীর শিক্ষার্থী সোহাগ চন্দ্র দাস। অন্য দিকে বালারহাট বাজরে বাবা ফজর আলীর মাছের দোকানে মাছ বিক্রি করছেন নাওডাঙ্গা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থী রুবেল মিয়া। তার পাশেই মামা সাহেব আলীর মাছের দোকানে মাছ বিক্রি করছেন কাশিয়াবাড়ী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থী খাজা মইনুদ্দিন। বিশ্বব্যাপী মরণঘাতী করোনা ভাইরাসে কারণে দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিশুরা শ্রম বিক্রি কাজে জড়িয়ে পড়েছেন। শিক্ষকসহ সচেতন মহলের অভিমত পরিবার সচেতন না হলে প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঝরে পড়া শিশুর সংখ্যা বাড়বে।
এরশাদুলের বাবা মফিজুর জানান একজনের আয়ে সংসার চলে না। ছেলের স্কুল বন্ধ তাই ছেলেকে কাজে লাগিয়েছি।
হাফিজুরের বাবা-ইজ্জত আলী জানান,বাহে আমরা খুবেই গরীব মানুষ। করোনার কারণে আয় কমেছে। তাই ছেলেটাকে মানুষের দোকানে রেখে দিয়েছি। স্কুল খুললে ছেলেকে স্কুলে পাঠানো হবে।
ফুলবাড়ী জছিমিয়া মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক আমিনুল ইসলাম জানান, করোনা কালে কাজের ক্ষেত্র সংকোচিত হয়ে পড়ায় নি¤œ আয়ের মানুষের সংসারে টানাপড়ন লেগেছে। এজন্য সংসার চালাতে হিমশিম পরিবারগুলোর অভিভাবকরা তাদের স্কুল পড়–য়া সন্তানদের বাড়তি আয়ের আশায় শিশুশ্রমে নিয়োজিত করছে। এই সব শিশুদের বিভিন্ন পেশা থেকে ফিরিয়ে আনতে শিক্ষকসহ ও অভিভাবকদেরও বিশেষ ভুমিকা রাখতে হবে।
এ প্রসঙ্গে উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো.তৌহিদুর রহমান জানান, বিষয়টি শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে মনিটরিং করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।