কথায় কথায় গুরুত্বপূর্ণ সড়ক অবরোধে দেশের ক্ষতি
বাংলাদেশের প্রাণকেন্দ্র রাজধানী ঢাকা। যে কোনো দাবি-দাওয়ার প্ররিপ্রেক্ষিতেই এই রাজধানীকে বেছে নেয়া হয়। অবরোধ করা হয় জনগুরুত্বপূর্ণ সব সড়ক। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সরকারের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে পরিবহন চলাচল বন্ধ করে দিয়ে বিক্ষোভ মিছিল করা হয়। এতে অনেক সময় ঘটনাস্থলসহ আশপাশের অনেক এলাকার জীবনযাত্রা থমকে যায়। সাধারণ মানুষকে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হয়। প্রশাসনের যারা দায়িত্ব পালন করেন, তাদের দুর্ভোঘের শেষ থাকে না। প্রতিদিন দেশকে কোটি কোটি টাকার ক্ষতির মুখে পড়তে হয়। জরুরি সেবা পরিবহন; বিশেষ করে রোগী বহনকারী গাড়িকেও অনেক সময় অসহায় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। অথচ দাবি আদায় করার আরো অনেক পথ-পন্থা রয়েছে। এভাবে জনগুরুত্বপূর্ণ সড়ক না আটকে, মানুষকে ভোগান্তিতে না ফেলে, রোগীদের সময়মতো হাসাপাতালে পৌঁছাতে বাধা দিয়ে বা রাষ্ট্রের ক্ষতি করে দাবি আদায় পদ্ধতি কাম্য নয়।
সবশেষ ৭ ডিসেম্বরও রাজধানী এমন ঘটনার সাক্ষী হয়েছে। এ দিন বিভিন্ন দাবিতে রাজধানীর পৃথক তিনটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন আন্দোলনকারীরা। এতে বিভিন্ন সড়কে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। সড়ক বন্ধ ও যানজটের কারণে ভোগান্তিতে পড়েন যাত্রীরা। যান চলাচল স্বাভাবিক রাখতেও হিমশিম খেতে হয় ট্রাফিক পুলিশকে।
সড়ক অবরোধের কারণে দেশের অর্থনীতিতে মারাত্মক প্রভাব পড়ে। মালবাহী যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পণ্য পরিবহন ও ডেলিভারিতে বিরতি ঘটে, ফলে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষতির সম্মুখীন হয়। ক্ষুদ্র, মাঝারি এবং বৃহৎ সকল ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, যা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও বিনিয়োগের পরিবেশকে সংকটাপন্ন করে।
গত রোববার সকাল ১০টার দিকে বাংলাদেশ মোবাইল বিজনেস কমিউনিটির ব্যানারে আগারগাঁওয়ের বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) ভবনের সামনের সড়ক অবরোধ করেন মোবাইল ব্যবসায়ীরা। দুপুর ১টায় প্রস্তাবিত ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাদেশ জারির দাবিতে শিক্ষাভবন ঘেরাও কর্মসূচি করেন সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা। এছাড়া সাত কলেজ নিয়ে গঠন হতে যাওয়া ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি প্রস্তাবিত ‘স্কুলিং কাঠামো’ বাতিল করার দাবিতে শাহবাগ মোড় আটকে বিক্ষোভ করেন উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা।
মোবাইল ব্যবসায়ীদের অবরোধ:
মোবাইল ব্যবসায়ীদের আগারগাঁও সড়ক অবরোধের কারণে ডাইভারশন দিয়ে অন্য সড়কে যান চলাচলের ব্যবস্থা করে ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগ, যার ফলে জাতীয় আর্কাইভ ভবনের সামনে, শ্যামলী, শিশু মেলাসহ আগারগাঁওয়ের আশপাশের সড়কগুলোয় যানবাহনের চাপ বেড়ে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। এতে গন্তব্যে যেতে যাত্রীদের দীর্ঘ সময় যানবাহনে আটকে থাকতে হয়। অনেক যাত্রীকে ভোগান্তি নিয়ে হেঁটেই গন্তব্যে যেতে দেখা গেছে। বেলা সাড়ে ৩টা পর্যন্ত মোবাইল ব্যবসায়ীরা সড়ক অবরোধ করে রাখেন।
এ বিষয়ে ডিএমপির ট্রাফিক তেজগাঁও বিভাগের শেরেবাংলা নগর জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) জাকির হোসেন বলেন, বিটিআরসি ভবনের সামনে মোবাইল ব্যবসায়ীদের সড়ক অবরোধের কারণে যান চলাচল বন্ধ ছিল। আমরা ডাইভারশন দিয়ে অন্য রাস্তায় যানবাহন চলাচলের ব্যবস্থা করি। আগারগাঁও একটি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক। এটি বন্ধ থাকায় অন্য রাস্তায় ব্যাপক চাপ পড়ে। বিভিন্ন সড়কে যানজটের সৃষ্টি হয়।
‘স্কুলিং কাঠামো’ বাতিল দাবিতে শাহবাগ অবরোধ উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের:
একই দিন দুপুর পৌনে ১২টায় ঢাকা কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তাবিত রূপরেখায় বর্ণিত স্কুলিং পদ্ধতি বাতিলের দাবিতে শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন ঢাকা কলেজসহ পাঁচ কলেজের উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা। বেলা ১১টার পর ঢাকা কলেজের উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা সায়েন্স ল্যাব মোড়ে জড়ো হন। পরে সরকারি বাংলা কলেজ, কবি নজরুল সরকারি কলেজ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী সরকারি কলেজ এবং বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজের শিক্ষার্থীরা একসঙ্গে মিছিল নিয়ে এসে শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন। এতে ওই মোড় দিয়ে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
অধ্যাদেশ জারির দাবিতে শিক্ষাভবন ঘেরাও:
বেলা ৩টা ২৫ মিনিটে হাইকোর্ট মোড় অবরোধ করেন কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশ ঘোষণার দাবিতে আন্দোলনরত সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা। এতে হাইকোর্ট মোড় দিয়ে প্রেসক্লাব, গুলিস্তান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সচিবালয় অভিমুখী যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। সন্ধ্যার পরও তাদের সেখানে অবস্থান করতে দেখা যায়। এর আগে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা দুপুর ১টা থেকে শিক্ষাভবনের সামনে অবস্থান নেন। আন্দোলনকারীরা জানান, তারা আজকের (রোববার) মধ্যেই অধ্যাদেশ ঘোষণা চান। অধ্যাদেশ ছাড়া তারা ফিরবেন না।
একদিনে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি স্থানে সড়ক অবরোধের কারণে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের ব্যাপক বেগ পেতে হয়েছে। ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. আনিছুর রহমান বলেন, বিভিন্ন দাবিতে সড়ক অবরোধের কারণে আমাদের প্রতিদিন ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা করতে খুবই কষ্ট হয়। আমাদের (ট্রাফিক) দম বেরিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়। এমনিতেই জনবহুল ঢাকায় যানবাহন চলাচলের পর্যাপ্ত রাস্তা নেই। তার মধ্যে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে রাস্তা বন্ধের কারণে আমাদের খুবই কষ্ট পোহাতে হয়। যাত্রীদেরও ভোগান্তি হয়।
আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, সবাই দেশের নাগরিক। সবাই দেশের ভালো-মন্দ বুঝি। কিন্তু আপনি (আন্দোলনকারী) সড়ক বন্ধ করে আন্দোলন করছেন, আপনি হয়তো জানেনও না আপনার কোনো আত্মীয় আন্দোলনের কারণে আটকা পড়ে হাসপাতালে যেতে না পেরে মারা গেছেন। আপনি হয়তো পরে খবর পাবেন। আপনার কর্মকাণ্ডে যদি একজন নিকট-আত্মীয় চিকিৎসা না পেয়ে মারা যান, তখন আপনার কেমন লাগবে- এ কথাটা বুঝতে হবে।
বিশ্লেষকরা বলেন, যে কোনো ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের দাবি-দাওয়া থাকতেই পারে। কিন্তু যথাযথ পদ্ধতিতে করতে হবে। সড়ক আটকে, মানুষকে বিপদে ফেলে, রাষ্ট্রের ক্ষতি করে এসব করা ভালো নয়। এই সংস্কৃতি থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। দেশের আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে কাজ করতে হবে।







