নিউজ ডেস্ক,বর্তমানকণ্ঠ ডটকম, সোমবার, ২১ মে ২০১৮:
চট্টগ্রামের কোতোয়ালী থানার নন্দনকানন এলাকায় চাঁদমনি ওরফে ইয়াছমিন (১৫) নামে গৃহকর্মী কিশোরীর মৃত্যু নিয়ে রহস্য দানা বেঁধেছে। ব্যবসায়ী গৃহকর্তা পরিবারের দাবি বকাঝকা করায় ভবনের উপর থেকে লাফিয়ে পড়ে ইয়াছমিন আত্মহত্যা করেছে। তবে এক কথা মানতে নারাজ তার তার পরিবার। তাদের দাবি ইয়াছমিনকে মেরে লাশ উপর থেকে ফেলে দিয়ে আত্মহত্যা বলে চালানোর চেষ্টা করছে। মৃত্যুর আগে ইয়াছমিনকে মারধর করেন বলেও অভিযোগ করেন তার মা ও ভাই।
এ ঘটনা মাত্র ২৫ হাজার টাকায় দফারফা করে পুলিশ ও গৃহকর্তার পরিবার। মামলা না করতে ধমকি দিয়ে সাদা কাগজে সই নিয়ে ২৫ হাজার টাকা দিয়ে মরদেহসহ ইয়াছমিনের মা-বাবাকে পাঠিয়ে দেয়া হয় চকরিয়ার কুটাখালী গ্রামের বাড়িতে। মেয়ের জীবনের মূল্য মাত্র ২৫ হাজার টাকা? মেয়ের মরদেহের সাথে ২৫ হাজার টাকা দিয়ে বলা হয় লাশ নিয়ে চলে যেতে।
ঘটনাটি ঘটেছে চট্টগ্রাম মহানগরীর কোতোয়ালী থানার নন্দনকানন একে ম্যানসনের ৯ম তলায়। গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে মর্মান্তিক এ ঘটনাটি ঘটলেও গণমাধ্যমের চোখকে ফাঁকি দিয়ে তড়িঘড়ি করে এ ঘটনা ধামাচাপা দেয়া হয়। রবিবার (২০ মে) এ ঘটনা জানাজানি হয় কিছুটা।
নন্দনকানন এ কে ম্যানসনের ৮ম তলায় ব্যবসায়ী জাফর আহমেদের বাসায় গৃহকর্মীর কাজ করত চাঁদমনি ওরফে ইয়াছমিন (১৫)। একই ভবনের নবম তলায় গোলাম সরোয়ার এর বাসায় কাজ করতো চাঁদমনির অপর দুই বোন জোৎসনা মনি ও সূর্য্য মনি। গত পাঁচ বছর ধরে এ বাসায় চাঁদ মনি কাজ করে আসছিল। কিন্তু দরিদ্রতা আর সৌন্দর্য্য দুটোই কাল হলো চাঁদ মনির জীবনে।
সুত্র জানায়, গত বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে একে ম্যানসন এবং পাশের ভবন কাদের টাওয়ারের মাঝামাঝি করিডোর গলি থেকে উপর হয়ে পড়ে থাকা ইয়াছমিনের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।
মরদেহের সুরতহালকারী কোতোয়ালী থানার উপ-পুলিশ পরিদর্শক রুহুল আমিন বলেন, ‘মরদেহের দুই পা এবং একহাত, পাজরের হাড় ভাঙা ছিল। মাথার এক পাশ ফেটে মগজ বের হয়ে যায়। চোখের উপরেও আঘাতের চিহ্ন।’
তিনি বলেন, ‘কীভাবে তার মৃত্যু হয়েছে ময়নাতদন্ত রিপোর্ট পেলে তা বলা যাবে।’ তবে এটি হত্যা না আত্মহত্যা এ নিয়ে স্পষ্ট কোনো মন্তব্য করেননি তিনি। এদিকে চাঁদ মনি আত্মহত্যা করেছে বলে জোর দাবি করছেন জাফর আহমেদের পরিবারের লোকজন।
তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই ভবনের একটি সূত্র জানান, ‘মেয়েটিকে বেদম মারধর করা হয়। এক পর্যায়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লে কৌশলে তাকে ভবনের উপর থেকে ফেলে দিয়ে আত্মহত্যা বলে প্রচার করা হয়।’
জাফর আহমদের শ্যালিকা সাবিনা মুক্তা বলেন, ‘তাদের বাসার ড্রাইভারের সাথে কথা বলতে নিষেধ করা এবং বকাঝকা করার কারণে ক্ষিপ্ত হয়ে চাঁদমনি আত্মহত্যা করে।’
সাবিনা মুক্তা বলেন, ‘বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তাঁর ছেলেকে বাসার সামনে দিয়ে চাঁদমনি চলে যায়। এরপর তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। অনেক খোঁজাখুঁজি করার পর বিষয়টি চাঁদমনির মা-বাবা এবং পুলিশকে জানানো হয়। অবশেষে রাতে ভবনের নিচে চাঁদমনির নিথর দেহ পরে থাকতে দেখে পুলিশকে খবর দেন তাঁরা। এরপর পুলিশ এসে মরদেহ উদ্ধার করে।’
সাবিনা বলেন, ‘তাদের ড্রাইভার সাহেদের সাথে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে চাঁদমনির। বৃহস্পতিবার বিকেলে ভবনের ছাদের উপরে দুজনে কথা বলতে দেখে জাফর আহমেদ তাদেরকে বকাবকি করেন। এরপর চাঁদমনির বোন বিষয়টি নিয়ে চাঁদ মনিকে জিজ্ঞাসা করলে চাঁ মনি বোনকে বলে তোদেরকে মজা দেখাবো ‘ বকাঝকা করার কারণে সে আত্মহত্যা করেছে বলে দাবি করেন তিনি।
এদিকে জাফর আহমদের বাসায় তার স্ত্রী হিরার সাথে এ প্রতিবেদক কথা বলতে চাইলে হিরার বোন সাবিনা বার বার নিজেই কথা বলেন। এসময় হিরাকে কথা বলতে দেননি সাবিনা। এছাড়া বাসার গৃহকর্তা জাফর আহমদকেও পাওয়া যায়নি। সাবিনার কাছে জাফর আহমদের মোবাইল নম্বর চাইলে তিনি এ প্রতিবেদককে কৌশলে সাবিনার স্বামী গোলাম সরোয়ারের নাম্বার দেন।
ড্রাইভার সাহেদ বিবাহিত বলে চাকরি নিলেও পরে বলে সে অবিবাহিত। এ প্রতিবেদক ওই নাম্বারে ফোন করে চাঁদমনির মৃত্যুর বিষয়ে জানতে চাইলে গোলাম সরোয়ার অনেকটা ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন কেন এত যন্ত্রনা দিচ্ছেন ? থানা বা কোর্টে জান সেখানে গিয়ে বিস্তারিত জানুন।
ঘটনার বিষয়ে খোঁজ খবর নিতে একে ম্যানসনের ৮ম তলায় জাফর আহমদের ফ্ল্যাটে গিয়ে দেখা যায় তাদের বাসায় তালাবদ্ধ। উপরে ৯ম তলায় গিয়ে গোলাম সরোয়ারের বাসায় পাওয়া যায় জাফর আহমদের স্ত্রী হিরাকে। কিন্তু পুরো পরিবারের লোকজনকে সিন্ডিকেট হয়ে কথা বলতে লক্ষ্য করা গেছে। এদিকে জাফর আহমদের ড্রাইভার সাহেদকে আটক করলেও পরে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। বর্তমানে সাহেদ জাফর আহমদের বাসায় গাড়ী চালাচ্ছেন। ড্রাইভার সাহেদ এর সাথে প্রেমের সম্পর্কের অভিযোগ আনলেও তার ব্যাপারে কোন ব্যবস্থা নেয়নি পুলিশ।
এ বিষয়ে চাঁদমনি ওরফে ইয়াছমিনের মা শাফিয়া বেগম বলেন, ‘জাফর আহমদের শ্যালিকা মুক্তা বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ফোন করে বলেন যে চাঁদমনিকে পাওয়া যাচ্ছে না। পরে রাতে ফোন করে বলেন, চাঁদমনি আত্মহত্যা করেছে।’
শাফিয়া বেগম বলেন, ‘আমার মেয়ে আত্মহত্যা করতে পারে না। তার মৃত্যু নিয়ে রহস্য রয়েছে। তাকে মেরে লাশ উপর থেকে ফেলে দিয়ে আত্মহত্যা বলে চালানোর চেষ্টা করছে।’ বৃহস্পতিবার তারা চাঁদমনিকে মারধর করেন বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
থানায় মামলা করেননি কেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা গরীব বলে পুলিশ মামলা নেয়নি। বলেছে মেয়ে মরে গেছে মামলা করে কি হবে। ওরা বড় লোক, ওদের সাথে লড়াই করে কি হবে। টাকাগুলো নিয়ে চলে যান, ময়নাতদন্ত রিপোর্ট আসলে মামলা হবে।’
তিনি বলেন, ‘২৫ হাজার টাকা দিয়ে সাদা কাগজে সই নিয়ে মেয়ের লাশ বুঝিয়ে দিয়ে আমাদেরকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হয়।’ চাঁদমনির ছোট বোন জোৎসনা মনি জানায়, তার বোন আত্মহত্যা করেনি। নিশ্চয় কোনো ঘটনা ঘটেছে যা আড়াল করা হচ্ছে।
জোৎসনা জানায়, তাদেরকে জাফর সাহেবের স্ত্রী হিরা চাঁদমনির সাথে কথা বলতে দিতেন না। এ ছাড়া চাঁদমনিকে প্রায়ই সময় মারধর করা হতো।
চাঁদমনির ভাই রিদওয়ান বলেন, তার বোন আত্মহত্যা করেনি। তাকে হত্যা করা হয়েছে দাবি করে রিদওয়ান বলেন, তার মৃত্যুর সঠিক কারণ উদঘাটন করা দরকার।
এ ব্যাপারে কোতোয়ালী থানার ওসি মো. মহসিন বলেন, চাঁদমনি নামে এক গৃহকর্মীর মরদেহ উদ্ধার করার পর এ বিষয়ে একটি অপমৃত্যু মামলা দায়ের করা হয়েছে। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পেলে পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে। এদিকে নিজের মেয়েকে হারিয়ে শোকের মাতম চলছে চাঁদমনির পরিবারে। শোকে স্তব্ধ পুরো পরিবার। পরিবারের সবাই এ ঘটনার সুষ্ঠ তদন্ত দাবি করেন।