নিউজ ডেস্ক,বর্তমানকণ্ঠ ডটকম, শনিবার, ১৮ নভেম্বর ২০১৭: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন- ‘স্বাধীনতার দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় শত বাধা উপেক্ষা করে মুক্তিযুদ্ধের সম্মান আর মর্যাদাকে বুকে ধারণ করে স্বাধীন বাংলাদেশ সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ভবিষ্যতেও সব বাধা পেছনে ঠেলে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে।’
শনিবার (১৮ নভেম্বর) রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি দেয়াকে কেন্দ্র করে এক নাগরিক সমাবেশে দেয়া ভাষণে এসব কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণের শুরুতে বলেন, ‘এই স্বাধীনতা ২৩ বছরের পরাধীনতা ও লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত। বাঙালি জাতির নিজস্ব আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠায় একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য বঙ্গবন্ধু সারাজীবন লড়াই-সংগ্রাম করে গেছেন।’
তিনি বলেন, ‘আমি শুরুতেই ইউনেস্কোকে ধন্যবাদ জানাই। তারা বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণটিকে স্বীকৃতি দিয়ে বাঙালি জাতির মর্যাদাকে আর উচ্চ শিখরে অধিষ্ঠিত করেছে।’
ইতিহাসের স্মৃতিচারণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ভাই ও বোনেরা আমার, এখানে দাঁড়িয়ে আমার সেইসব দিনগুলোর কথা মনে পড়ছে। হাজার মাইলে ব্যবধানে থাকা পশ্চিম পাকিস্তানিদের দ্বারা যখন শোষিত বঞ্চিত নিগৃহিত হচ্ছিল গোটা বাঙালি জাতি। মাকে ‘মা’ বলে ডাকার অধিকার কেড়ে নিতে চেয়েছিল শোষকেরা। এই মাটিতে বাংলা ভাষার কবর রচনা করতে চেয়েছিল তারা। ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় বঙ্গবন্ধু মাতৃভাষা রক্ষার আন্দোলন সংগ্রাম শুরু করেন। এরই পথ ধরে তাঁর নেতৃত্বে একাত্তরের রণাঙ্গণে বিজয় অর্জন করে জাতি।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘জাতির পিতার ডাকে সাড়া দিয়ে সেদিন এদেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সেদিন লাখো মানুষ সমবেত হয়েছিল। প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে মানুষ এসেছিল। লগি-বৈঠা হাতে নিয়ে সেদিন জনসমুদ্র নেমেছিল তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে- শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধুর দিকনির্দেশনা শোনার জন্য।’
বঙ্গবন্ধুর রাজনীতিতে শেখ হাসিনা তাঁর মায়ের ভূমিকার কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে বলেন, ‘সেদিনের ভাষণের কথা স্মরণ করলে আমার মায়ের কথা স্মরণে পড়ে। ভাষণ দেয়ার কিছুক্ষণ আগে আমার মা আমার বাবাকে নিয়ে তার শোবার ঘরে যান। মা তখন আব্বাকে বলেন- তুমি অন্তত ১৫টি মিনিট বিশ্রাম নাও। কারণ তখন অনেকেই অনেক ধরনের পরামর্শ দিচ্ছিলেন। আব্বার কাছে লিখিত অলিখিত অনেক বক্তব্য আসছিল। আসলে তখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কী ধরনের ভাষণ দেয়া উচিত তা নিয়েও চিন্তা-ভাবনা চলছিল। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল আমি তখন সেখানে উপস্থিত ছিলাম। আব্বার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলাম। মা শুধু আব্বাকে একটি কথাই বলেছিলেন- সারাজীবন জাতির মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছ। তোমার মনে যা আসে, মন যা বলে তুমি যা বিশ্বাস করো ভাষণে তাই বলবে। আমার মা প্রকাশ্য রাজনীতি না করলেও তাঁর রাজনৈতিক চেতনা ছিল প্রখর। ওই দিন আব্বাকে তিনি যে পরামর্শ দিয়েছিলেন আমি মনে করি একজন রাজনীতিকের স্ত্রীর পক্ষ থেকে এর চেয়ে মহৎ পরামর্শ আর কিছু হতে পারে না।’
“বঙ্গবন্ধু ভাষণ মঞ্চে দাঁড়িয়ে সেই কথাগুলোই সেদিন বলেছিল- যা তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন। বাঙালি জাতির মুক্তির সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে জাতিকে প্রস্তত হওয়া ডাক দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে গোটা জাতি সেদিন ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। ভাষা আন্দোলন থেকে ধাপে ধাপে আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে যেভাবে বাঙালি জাতি এগোচ্ছিল এবং স্বাধীনতা অর্জনে যা যা করণীয় তার সবরকম দিকনির্দেশনা ছিল ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে।”
“সেই ভাষণে তিনি ২৩ বছরের বঞ্চনা, নিপীড়ন অত্যাচারের কথা বলেছিলেন। করণীয় সম্পর্কে বলেছিলেন। সেদিন সেই ভাষণে বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন। বাঙালি জাতি স্ব স্ব জায়গা থেকে বঙ্গবন্ধু নির্দেশনা অনুযায়ী সেদিন অসহযোগ আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন।”
মুজিবকন্যা আরও বলেন, ‘জাতির পিতা জানতেন, পাকিস্তান সরকার কখনও স্বেচ্ছায় ক্ষমতা দেবে না। যুদ্ধ করেই ক্ষমতা ও মুক্তি অর্জন করতে হবে। সেজন্য যা যা প্রস্তুতি দরকার সব তিনি নিয়েছিলেন। কিভাবে যুদ্ধ পরিচালিত হবে, অস্ত্র কোথায় থেকে আসবে, ট্রেনিং কীভাবে নেবে, অর্থের যোগান আসবে কোথায় থেকে ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু তারও ইঙ্গিত দিয়ে গিয়েছিলেন।’
তৎকালীন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের ম্যান্ডেন্ট নিতেই বঙ্গবন্ধু ১৯৭০ সালের নির্বাচন করেছিলেন এবং বিজয় লাভ করেছিলেন বলেও দাবি করেন শেখ হাসিনা।
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধ শেষে মিত্রশক্তির সহায়তায় এই সোহরাওয়ার্দীতেই পাকিস্তানি সেনারা সেদিন আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিল। বাঙালির যুদ্ধজয়ের পরই বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তান কারাগারে বন্দি করা হলো। তার বিরুদ্ধে ফাঁসির আদেশ দেয়া হলো। কিন্তু এদেশে যেহেতু হাজার হাজার পাকিস্তানি সেনা তখনও অবস্থান করছিল সেই অবস্থায় মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রশক্তির কথা মাথায় রেখে পাকিস্তান সরকার সেদিন জাতির এই মহান নেতার ফাঁসি করতে ভয়ে কেঁপে উঠেছিল। তারা কারাগার থেকে শেখ মুজিবকে মুক্ত করে দিতেও বাধ্য হয়েছিল।’
মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বঙ্গবন্ধুর ভূমিকার কথা স্মরণ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘একটা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের ধ্বংস স্তুপের উপর যাত্রা শুরু করে মাত্র ৯ মাসের মধ্য একটি সংবিধান উপহার দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। সেই সংবিধান অনুযায়ী তিনি নির্বাচনও করেছিলেন। কিন্তু যখন তিনি দেশকে অর্থনৈতিক অগ্রগতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন ঠিক তখনই পাকিস্তানের দোসররা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর মুজিবসেনাদের ৭ মার্চের ভাষণ বাজানো বন্ধ করতে বলা হয়েছিল। কিন্তু যত বাধা এসেছে ততই বঙ্গবন্ধু সেই ভাষণ মুজিবসেনারা আরও বেশি করে বাজিয়েছে। পৃথিবীতে আরও কোনও ভাষণ এত সময় বাজানো হয়নি।’
বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর স্বাধীনতার ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়েছে বলেও বলেও মন্তব্য করেন সরকারপ্রধান।
তিনি বলেন, ‘আমাদের দুর্ভাগ্য আমাদের দেশে যারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করলো তারাই ভাষণ বন্ধের ঘোষণা দিলো। তারা কারা? যারা ’৭৫ এর ১৫ আগস্টের পর ক্ষমতায় এসেছিল তারাই সেই ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু ইতিহাসের সত্য কখনও মুছে ফেলা যায় না। ইতিহাস ঠিকই তার জায়গা করে নেয়। ইতিহাসও প্রতিশোধ নেয়।’
ইতিহাস বিকৃতিকারী ও স্বাধীনতাবিরোধীদের উদ্দেশ্যে শেখ হাসিনা আরও বলেন, ‘আজ যখন ইউনেস্কো ৭ মার্চের ভাষণকে ঐতিহাসিক স্বীকৃতি দিলো তখন কি সেইসব মাথা নিচু হয়নি। আজ কি তাদের লজ্জা হয় না। জানিনা তাদের লজ্জা আছে কি না। অবশ্য তারা তো পাকিস্তানের প্রেতাত্মা।’
তিনি বলেন, ‘আমি আশা করবো- এই স্বীকৃতি শুধু স্বীকৃতিই নয়, এই ভাষণের স্বীকৃতির মধ্যদিয়ে গোটা জাতি আবারও মুক্তিযুদ্ধের স্বাধীনতার চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হবে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আর যেন পাকিস্তানের প্রেতাত্মারা বাঙালার মাটিতে ঘাঁটি গাড়তে না পারে, আর যেন কোনও অপশক্তি ইতিহাস বিকৃতির সুযোগ না পায় সেজন্য স্বাধীনতার শক্তিকে ক্ষমতায় রাখতে হবে। ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে সেটি প্রমাণ করেছিল।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জাতির পিতা রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা, অর্থনৈতিক মুক্তি আনতে চেয়েছিলেন। এর জন্য তিনি সারাটা জীবন লড়াই সংগ্রাম করেছেন। কখনও আপস করেননি।’
২১ ফ্রেব্রুয়ারিকেও ইউনেস্কো আন্তর্জাতিক মাতৃভার্ষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ায় সংস্থাটির প্রতি ধন্যবাদ জানিয়ে পরিশেষে শেখ হাসিনা বলেন, ‘দেখুন ভাই ও বোনেরা, গত কয়েক দিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছিল। বাংলার আকাশে আজ সূর্য উঁকি দিয়েছে। এই সূর্যই সব অন্ধকার দূরে ঠেলে বাংলাদেশকে আলোর পথে লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।’
এর আগে দুপুর ২টা ৪০ মিনিটে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের মাধ্যমে নাগরিক সমাবেশ শুরু হয়।
নাগরিক সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন, ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে স্বীকৃতি দেওয়ায় বাংলাদেশে নিযুক্ত ইউনেস্কোর কান্ট্রি ডিরেক্টর বিট্রিস কালদুলের হাতে একটি ধন্যবাদ প্রস্তাব হস্তান্তর করা হয়। এর আগে ধন্যবাদপত্র পাঠ করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন, নজরুল গবেষক অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম, সমকাল সম্পাদক গোলাম সারওয়ার, শহীদ জায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. জাফর ইকবাল।
নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার ও শহীদ বুদ্ধিজীবী আবদুল আলীম চৌধুরীর মেয়ে ডা. নুজহাত চৌধুরীর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে আবৃত্তি করেন কবি নির্মলেন্দু গুণ ও সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিয়ে শিল্পকলা একাডেমির সমবেত সংগীতের পর একক সংগীত পরিবেশন করেন কণ্ঠশিল্পী মমতাজ। এছাড়া কিরণ চন্দ্র রায়ের স্ত্রী চন্দনা মজুমদার লোক গান পরিবেশন করেন।