মঙ্গলবার (১৪ মে) দুপুর আড়াইটা। চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি-১ জেটিতে কেএসআরএম গ্রুপের একটি মিনিবাস এসে পৌঁছায়। দরজা খোলার পর একে একে নেমে আসেন এমভি আবদুল্লাহ জাহাজের ২৩ নাবিকের কয়েকজন স্বজন। কারও এসেছেন মা, কারও বাবা, আবার কারও ভাই-বোন কিংবা সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে আসা স্ত্রী। প্রিয়জনকে গ্রহণ করতে তারা এসেছেন ফুল, ফল, মিষ্টিসহ মুখরোচক অনেক খাবার নিয়ে। গ্রীষ্মের তীব্র খরতাপে দাঁড়িয়ে তাদের চোখ শুধু কর্ণফুলী নদীর মোহনার দিকে। নাবিকদের বহন করা হলুদ রঙের এমভি জাহান মণি বন্দরের জলসীমায় দৃশ্যমান হওয়া মাত্রই স্বজনদের চোখে-মুখে ভেসে ওঠে উচ্ছ্বাসের ছাপ।
ধীরে ধীরে দুটি টাগবোর্ডের পাহারায় এমভি জাহান মণিকে আনা হয় বন্দরের এনসিটি-১ জেটিতে। তখনই অপেক্ষমাণ স্বজনরা নাবিকদের উদ্দেশে হাত নাড়াতে থাকেন। বিকেল সাড়ে ৪টা নাগাদ নাবিকরা জাহান মণি থেকে নামতে শুরু করেন। এমভি আবদুল্লাহ জাহাজের চিফ অফিসার আতিকুল্লাহ খান জেটির ফ্লোরে পা রাখতেই তার দুই মেয়ে ইয়াশরা ও উনাইজা দৌড়ে গিয়ে বাবার কোলে উঠে পড়ে। বাবার বুকে বুক লাগিয়ে তারা শান্ত হয়ে মাথা নুইয়ে থাকে। একপর্যায়ে তারা ঘুমিয়ে পড়ে। বাবাকে কারও সঙ্গে মিশতেই দিচ্ছিল না তারা।
বাবাও পরম আদরে দুই মেয়েকে জড়িয়ে ধরেই গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে কথা বলছিলেন। জানাচ্ছিলেন জিম্মিদশার ভয়াবহ দিনগুলোর কথা। আতিকুল্লাহ খানের দুই মেয়েকে দীর্ঘক্ষণ জড়িয়ে রাখার দৃশ্য উপস্থিত সবার নজর কাড়ে। এ সময় আতিকুল্লাহ খান আবেগে-আপ্লুত হয়ে চোখের পানি মোছেন।
তিনি বলেন, ‘কল্পনা করিনি আমার বুকের ধনগুলোর কাছে ফিরতে পারব। আজ ওরা যেমন আমাকে ছাড়ছে না, আমারও ওদেরকে ছাড়তে মন চাইছে না। ইচ্ছে করছে তাদের সারাক্ষণ কোলে রাখি। কলিজার টুকরাগুলো কতদিন তাদের বাবাকে দেখে না। জিম্মিদশা কী তাও তারা জানে না। শুধু এইটুকু বোঝে, বাবা তাদের বিপদে ছিলেন।’
তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া ইয়াশরা বলে, ‘বাবা জাহাজে বন্দি থাকার দিনগুলোতে সারাক্ষণ কেঁদেছি। আমার মা সারাক্ষণ নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করেছেন। বাবা ফিরে এসেছেন। এখন বাবাকে নিয়ে ঘুরতে যাব।’
এর আগে গত ১২ মার্চ সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাতে জিম্মি হয় এমভি আবদুল্লাহ। সর্বপ্রথম জাহাজের চিফ অফিসার আতিকুল্লাহ খানের পাঠানো ভয়েজেই সারা দেশে এমভি আবদুল্লাহ জাহাজ জিম্মি হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ে। প্রায় এক মাস পর মুক্তিপণের বিনিময়ে ১৪ এপ্রিল ভোরে জলদস্যুদের কবল থেকে মুক্ত হয় ২৩ নাবিক। এরপর জাহাজটি পৌঁছে দুবাইয়ের আল হামরিয়া বন্দরে। সেখান থেকে মিনা সাকার নামের আরেকটি বন্দরে চুনাপাথর ভর্তি করার পর চট্টগ্রাম বন্দরের উদ্দেশে রওনা দেয়।
সোমবার (১৩ মে) জাহাজটি কক্সবাজারে কুতুদিয়ায় নোঙর করে। মঙ্গলবার বিকেলে জাহাজটির ২৩ নাবিক জাহান মণি জাহাজে করে চট্টগ্রাম বন্দরে এসে মাটি স্পর্শ করে। সব মিলিয়ে ৬৫ দিনের জিম্মিদশা ও সাড়ে পাঁচ মাসের দেশত্যাগের পর মুক্ত নাবিকরা দেশে ফিরলেন।