আন্তর্জাতিক ডেস্ক | বর্তমানকণ্ঠ ডটকম:
নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের দুইটি মসজিদে হামলার ৯ মিনিট আগে হামলাকারী ব্রেনটন হ্যারিসন টারান্ট দেশটির প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডেনের কার্যালয়ে ইশতেহার (মেনিফেস্টো) পাঠিয়েছিলেন। একই মেনিফেস্টো পাঠানো হয়েছে নিউজিল্যান্ডের কয়েকজন প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ এবং দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমের কাছেও।
ফ্রান্সভিত্তিক সংবাদ সংস্থা ‘এএফপি’র খবরে বলা হয়েছে, ‘নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডেন রবিবার (১৭ মার্চ) সাংবাদিকদের বলেছেন, হামলাকারী ৩০ জায়গায় তার ইশতেহার পাঠিয়েছেন। এর মধ্য আমার কার্যালয়ও আছে। হামলার ৯ মিনিট আগে এই ই-মেইল পাওয়া যায়। তবে এটা কোথা থেকে পাঠানো, তার অবস্থান জানা যায়নি।’
তিনি বলেন, এই মেইল পাওয়ার দুই মিনিট পরই তা পুলিশের কাছে পাঠানো হয়।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ‘এনডিটিভি’র খবরে বলা হয়েছে, যে অ্যাকাউন্টে হামলার ৯ মিনিট আগে মেইলটি পাঠানো হয়েছে, সেটি প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত না। প্রধানমন্ত্রীর দফতরের কর্মকর্তারা মেইলটি ব্যবহার করেন। প্রধানমন্ত্রীর দফতরের একজন কর্মকর্তা মেইলে পাঠানো ওই ইশতেহার দেখতে পান। তিনি সেটা সংসদীয় নিরাপত্তা বিভাগের কাছে পাঠিয়ে দেন। সেখান থেকে পাঠানো হয় পুলিশের কাছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ওই কর্মকর্তা ব্রেনটন হ্যারিসন টারান্টের পাঠানো ইশতেহার হয়তো ততটা গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেননি।
প্রধানমন্ত্রীর একজন মুখপাত্র বলেন, ‘মেইলে ব্রেনটন হ্যারিসন টারান্ট এই কাজের কারণ উল্লেখ করেছেন। কিন্তু কী করতে যাচ্ছেন, তা বলেনি। তাই এটা আটকে দেওয়া বা রুখে দেওয়ার সুযোগ পাওয়া যায়নি।’
নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর প্রধান প্রেস সচিব অ্যান্ড্রো ক্যাম্পবেল জানান, একজন কর্মকর্তার অ্যাড্রেসে ইমেইলটি পাঠানো হয়েছিল। তবে তাৎক্ষণিকভাবে বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টিগোচর হয়নি। নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও দেশটির স্পিকার এবং অন্য রাজনীতিকদের কাছেও ওই মুসলিমবিদ্বেষী ইশতেহারটি ইমেইল করেছিল খুনি অস্ট্রেলীয় নাগরিক ব্রেন্টন ট্যারান্ট। ৭৪ পৃষ্ঠার ১৬ হাজার ৫০০ শব্দের ওই ইশতেহারে নৃশংস এ হামলার পেছনে নিজের বক্তব্য তুলে ধরে এই অস্ট্রেলীয় নাগরিক। ওই ইশতেহারের নাম তিনি দিয়েছেন ‘দ্য গ্রেট রিপ্লেসমেন্ট’।
সেখানে মোটা দাগে উঠে আসে মুসলিমবিদ্বেষ, অভিবাসী বিদ্বেষ ও শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদের মতো বিষয়গুলো। মুসলমানদের উসমানীয় খেলাফতের (বর্তমান তুরস্ক) বিরুদ্ধে তৎকালীন ইউরোপীয় খ্রিষ্টানদের বিজয়ের কথাও উল্লেখ করেছে সে। বর্তমান তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগানের মৃত্যুও কামনা করে হামলাকারী।
কথিত ইশতেহারে নিউজিল্যান্ডের ইতিহাসের এই নৃশংস খুনি দাবি করেছে, শ্বেতাঙ্গরা গণহত্যার শিকার এবং সে যুক্তরাষ্ট্রে গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে দিতে চায়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ‘শ্বেতাঙ্গ পরিচয়ের নতুন প্রতীক’ হিসেবে আখ্যায়িত করে মুসলমানদের জন্য একটি ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টিরও আহ্বান জানিয়েছে সে।
ইসলামের বিরুদ্ধে সহিংসতার বিষয়ে ট্যারান্টের এক ধরনের আসক্তি রয়েছে। নরওয়ের আরেক বন্দুকধারী খুনি আন্ড্রেস ব্রেইভিকের সাথে তার ‘গভীর যোগাযোগ’ ছিল। সে এ হামলা চালানোর জন্য তাকে উসকানি দিয়েছে। ব্রেইভিক ২০১১ সালে নরওয়েতে হামলা চালিয়ে ৭৭ জনকে হত্যা করেছিল।
কথিত ইশতেহারে হামলাকারী নিজের সম্পর্কে বলেছে, ‘আমার ভাষার উৎস ইউরোপীয়। আমার রাজনৈতিক আদর্শ ইউরোপীয়। আমার দার্শনিক অবস্থান ইউরোপীয়। আমার পরিচয়, আমি ইউরোপীয়। আর সবচেয়ে বড় কথা, আমার রক্ত ইউরোপীয়।’ লেখক তার পরিচয় দিতে গিয়ে লিখেছে, সে একটি শ্রমজীবী শ্রেণীর নিম্ন আয়ের পরিবারে বেড়ে উঠেছে। তার ভাষ্য, ‘আমি একটা সাধারণ পরিবার থেকে আসা সাধারণ এক শ্বেতাঙ্গ পুরুষ, যে তার নিজ গোষ্ঠীর মানুষের ভবিষ্যৎ সুরক্ষায় ভূমিকা রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমার বাবা-মা স্কটিশ-আইরিশ-ইংলিশ বংশোদ্ভূত। আমার একটা সাধারণ শৈশব কেটেছে, যেখানে বলার মতো কোনো ঘটনা নেই।’ তার দাবি, সে একজন ‘অন্তর্মুখী’ মানুষ, একজন ‘নৃতাত্ত্বিক জাতীয়তাবাদী’ ও ‘ফ্যাসিস্ট।’
ট্যারান্ট লিখেছে, এই হামলার পরিকল্পনা দুই বছর আগের। নিউজিল্যান্ড হামলার স্থান হিসেবে প্রথম পছন্দ ছিল না। তিন মাস আগে হামলার জন্য নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চকে বেছে নেয়া হয়। ‘আমি নিউজিল্যান্ডে এসেছিলাম সাময়িক সময়ের জন্য, পরিকল্পনা প্রণয়ন ও প্রশিক্ষণ নিতে। কিন্তু এখানে এসে আমি আবিষ্কার করি, বিশ্বের অন্য যেকোনো ভালো টার্গেটের চেয়ে এটি কোনো অংশে কম নয়।’ এই অস্ট্রেলীয় খুনির ভাষায়, ‘আমি বার্তা দিতে চেয়েছিলাম যে, দুনিয়ার কোনো স্থানই নিরাপদ নয়। আমি সংশ্লিষ্ট অস্ত্রটি এই কারণেই বেছে নিয়েছিলাম যেন ঘটনাটি ব্যাপক প্রচার পায়, মানুষের আলোচনায় ও সংবাদমাধ্যমে গুরুত্ব পায়।’
প্রসঙ্গত, শুক্রবার ( ১৫ মার্চ) স্থানীয় সময় দুপুর দেড়টার দিকে ক্রাইস্টচার্চে আল নুর মসজিদে জুমার নামাজ আদায়রত মুসল্লিদের ওপর প্রথমে সন্ত্রাসী হামলা হয়। কিছু পরে লিনউড মসজিদে দ্বিতীয় হামলা হয়। দুটি মসজিদে হামলায় ৫০ জন নিহত হন। আহত প্রায় ৫০ জন। কিছু পরে লিনউড মসজিদে দ্বিতীয় হামলা হয়।
আল নুর মসজিদে স্বয়ংক্রিয় রাইফেল নিয়ে হামলার ঘটনাটি ফেসবুকে লাইভস্ট্রিম করেন হামলাকারী ব্রেনটন হ্যারিসন টারান্ট। আল নুর মসজিদে আনুমানিক ৩০০ এবং লিনউড মসজিদে শ খানেক মুসল্লি নামাজ আদায় করছিলেন বলে জানা গেছে।
নিউজিল্যান্ডের পুলিশ কমিশনার মাইক বুশ বলেছেন, হামলায় নিহত ব্যক্তিদের পরিচয় এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়নি। তবে নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের ইতিমধ্যে অবহিত করা হয়েছে। মরদেহগুলো শনাক্তের কাজ দ্রুত করা হচ্ছে।
হ্যারিসন টারান্টের নৃশংসতার কবল থেকে কয়েক মিনিটের জন্য রক্ষা পেয়েছেন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের খেলোয়াড়েরা। শুক্রবার জুমার নামাজ আদায় করতে তারা ওই সময় গিয়েছিলেন মসজিদে। একজন নারী বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের ভেতরে প্রবেশ করতে নিষেধ করেন। এরপরই দ্রুত ওই স্থান ছেড়ে চলে যান ক্রিকেটাররা।