রাজনৈতিক দলে সংকট, সমঝোতার চেষ্টায় সরকার
গত কয়েক মাস ধরে জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশন জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেছে। অনেক জায়গায় তারা একমতও হয়েছেন। কিন্তু ২৮ অক্টোবর প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে কমিশন তাদের সনদের সুপারিশমালা জমা দেওয়ার পর থেকেই রাজনৈতিক দলগুলোগুলোর মধ্যে সংকট সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে বিএনপি বেশি ক্ষুব্ধ হয়েছে। তারা বলছে- কমিশন জাতির সঙ্গে প্রতারণা করেছে। কারণ, জুলাই সনদে আগে যা ছিল, তাতে কমিশন পরিবর্তন করেছে। এরপর সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, এই সংকট মোকাবিলা করতে এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে সমঝোতা-উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ এবং জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহেরের সঙ্গে কথা বলেছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টারা। এরপর শুক্রবার (৩১ অক্টোবর) দুপুরে মিন্টো রোডে মন্ত্রীপাড়ায় দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টারা নিজেরা বৈঠক করেছেন। বেশ কয়েকজন উপদেষ্টা এ তথ্য জানিয়ে বলেছেন, রাজনৈতিক সমঝোতার পর জুলাই সনদ বাস্তবায়ন-সংক্রান্ত আদেশ জারি হতে পারে।
গত ২৯ অক্টোবর উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। এ বিষয়ে কয়েকজন উপদেষ্টাকে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক আলোচনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। বৈঠকে নির্বাচনকালীন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং প্রশাসন ও পুলিশের রাজনৈতিক পক্ষপাতের চ্যালেঞ্জ নিয়েও মতবিনিময় হয়।
জানা গেছে, অধিকাংশ উপদেষ্টা মনে করেন— জুলাই সনদকে বাধ্যতামূলক না রেখে পরবর্তী সংসদে সংবিধান সংস্কার পরিষদের নির্দেশনামূলক দলিল হিসেবে রাখা উচিত। তারা নির্বাচন ও গণভোট একদিনেই আয়োজনের পরামর্শ দিয়েছেন। আইনগত কাঠামো বিবেচনায় ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ-২০২৫’ রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে জারি করা হলে তা অধিকতর গ্রহণযোগ্য হবে বলেও মত দেন তারা। এসব বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের এখতিয়ার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ওপরই ন্যস্ত রয়েছে। পরিষদের এ বৈঠকে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া উপস্থিত না থাকলেও অপর ছাত্র উপদেষ্টা মাহফুজ আলম উপস্থিত ছিলেন।
সমঝোতার পথে আলোচনা:
জুলাই সনদ বাস্তবায়ন এবং গণভোটের সময়সীমা নিয়ে রাজনৈতিক সংকট গভীর হওয়ায় তা নিরসনে পরিষদের সিদ্ধান্তে দলগুলোর সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু করেছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টারা।
বিএনপি ১৫টি সংস্কারে নোট অব ডিসেন্ট দিলেও উপদেষ্টারা দলটিকে উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতি এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গঠন প্রক্রিয়া— এই দুই আপত্তি প্রত্যাহারের অনুরোধ জানিয়েছে। অন্যদিকে, জামায়াতকে নির্বাচনের আগে গণভোটের দাবি ও নিম্নকক্ষে পিআর পদ্ধতির প্রস্তাব ত্যাগের অনুরোধ জানানো হয়েছে।
দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টারা জানিয়েছেন, বিএনপি উচ্চকক্ষে পিআর নিয়ে পর্যালোচনার ইঙ্গিত দিয়েছে। তবে তাদের শর্ত— প্রথমে জামায়াতকে নির্বাচনের আগে গণভোট এবং নিম্নকক্ষে পিআরের দাবি প্রকাশ্যে ত্যাগ করতে হবে। অন্যদিকে জামায়াত জানিয়েছে, বিএনপি সনদ অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার গঠন এবং উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতি মেনে নিলে তারা সমঝোতায় রাজি।
গত ২২ জুলাই যমুনায় বিএনপি প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতি নিয়ে পুনর্বিবেচনার অনুরোধ জানান। তবে দলটি স্পষ্ট জানিয়ে দেয়— এ বিষয়ে তাদের অবস্থান পরিবর্তনের কোনো সুযোগ নেই। এই প্রেক্ষাপটে সংকট নিরসনে বিএনপির সর্বোচ্চ নেতৃত্বের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা শুরু করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে প্রধান উপদেষ্টাকে।
মেয়াদ শেষ ঐকমত্য কমিশনের:
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ শুক্রবার (৩১ অক্টোবর) শেষ হয়েছে। গত মঙ্গলবার সরকারের কাছে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ এবং আদেশের দুটি খসড়া দিয়েছে কমিশন। এর মাধ্যমে কমিশন তার কাজের ইতি টেনেছে।
সনদ-গণভোট ঘিরে মতপার্থক্য:
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, দুদক ও পুলিশ সংস্কারসহ মোট ১৬৬টি সুপারিশ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সাত মাসের সংলাপ শেষ করে।
কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সংখ্যাগরিষ্ঠতায় ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাবে ঐকমত্য হয়েছে। তবে, ৬১টি সংস্কার প্রস্তাবে কোনো না কোনো দলের নোট অব ডিসেন্ট (ভিন্নমত) রয়েছে। বিশেষভাবে, সংবিধান সংশোধন প্রয়োজন এমন ৪৮টি প্রস্তাবের মধ্যে ৩৬টিতে এক বা একাধিক দলের ভিন্নমত আছে। যেগুলোকে মৌলিক সংস্কার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, তার মধ্যে ৯টিতে বিএনপির ভিন্নমত রয়েছে।
বিএনপির দাবিতে ১৭ অক্টোবর, প্রধান উপদেষ্টার উপস্থিতিতে স্বাক্ষরিত জুলাই সনদে নোট অব ডিসেন্ট যুক্ত করা হয়। নথিতে বলা হয়, যে দল কোন সংস্কার প্রস্তাবে ভিন্নমত জানিয়েছে, তা নির্বাচনী ইশতেহারে অন্তর্ভুক্ত করা হবে এবং জয়ী হলে আগামী সংসদে সেই অনুযায়ী সংস্কার কার্যকর করা হবে।
তবে জামায়াত, এনসিপি ও ইসলামী আন্দোলনসহ কিছু দল এই ব্যবস্থার বিরোধী। তাদের যুক্তি — গত জুলাইয়ে নোট অব ডিসেন্টের নিয়ম রাখা হয়েছিল, তখন গণভোটের সিদ্ধান্ত ছিল না। ফলে গণভোটে ঐকমত্য সৃষ্টির পর রাজনৈতিক দলের নোট অব ডিসেন্টের কার্যকারিতা অগ্রাহ্য হবে।
গণভোট ও বিএনপির অবস্থান পরিবর্তন:
জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন গত জুনে গণভোটের দাবি তোলে। বিএনপি শুরুতে এর পক্ষে ছিল না, কিন্তু ১৭ সেপ্টেম্বর তাদের অবস্থান পরিবর্তিত হয়। তারা জানান— তারা গণভোটে রাজি।
৫ অক্টোবর বিএনপি জানায়, গণভোট নির্বাচনের দিনেই আয়োজন হবে। অন্যদিকে, জামায়াত, ইসলামী আন্দোলনসহ মোট আট দল নির্বাচনের আগে গণভোটের দাবি তোলায় বিএনপি এটিকে নির্বাচন বিলম্বিত করার কৌশল আখ্যা দিয়েছে। বিএনপি অভিযোগ করেছে— স্বাক্ষরিত জুলাই সনদ অগোচরে পরিবর্তন করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ—
# বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি প্রদর্শন-সংক্রান্ত সংবিধানের ৪(ক) অনুচ্ছেদ বাতিলের সিদ্ধান্ত সনদে অন্তর্ভুক্ত হয়নি।
# সংবিধানের ১৫০(২) অনুচ্ছেদের সপ্তম তফশিল বিলুপ্ত করার সিদ্ধান্তও সনদ থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
সংস্কারের বাধ্যবাধকতা ও বিতর্ক:
বিএনপি গণভোটের সময়, সনদে সংস্কারের বাধ্যবাধকতার সমালোচনা করছে। তবে জামায়াত ও এনসিপি সংস্কারের বাধ্যবাধকতাকে সমর্থন করে আওয়ামী লীগ মনোনীত রাষ্ট্রপতি নয়, গণঅভ্যুত্থানে গঠিত সরকারপ্রধানের মাধ্যমে সাংবিধানিক আদেশ জারি করতে চায়।
কমিশন বিএনপির অভিযোগ প্রকাশ্যে সরাসরি ব্যাখ্যা না দিলেও একজন সদস্য জানিয়েছেন, ১০ অক্টোবর রাজনৈতিক দলগুলোকে চিঠি দিয়ে ৪(ক) অনুচ্ছেদ বাতিলের সম্মতি নেয়া হয়। ঐকমত্য হওয়ায় এটি সনদে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। সনদে স্বাক্ষর হওয়ার আগের রাতে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র-সংক্রান্ত ১৫০(২) অনুচ্ছেদের সপ্তম তফশিল বহাল রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
উপদেষ্টারা জানিয়েছেন, অনির্ধারিত আলোচনায় ড. মুহাম্মদ ইউনূস কোনো বিষয়ে ব্যক্তিগত মন্তব্য করেননি। তিনি সব উপদেষ্টার মতামত মনোযোগ দিয়ে শোনেন। পরে জানিয়েছেন, সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ ও মতামত পর্যালোচনা করার পর তিনি কয়েক দিনের মধ্যে গণভোট ও আদেশ জারির সিদ্ধান্ত ঘোষণা করবেন। এই সময়ের মধ্যে রাজনৈতিক সমঝোতার প্রক্রিয়া এগিয়ে নেয়ার জন্য কয়েকজন উপদেষ্টাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।







