বিএনপিতে ক্ষুব্ধ ভোটাররা চান দুর্নীতিমুক্ত প্রার্থী
সুনামগঞ্জের সর্বত্র বইছে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হাওয়া। রাজনৈতিক দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা গণসংযোগ, সভা-সমাবেশে ব্যস্ত সময় পার করছেন। প্রায় দেড় যুগ পরে কাঙ্খিত ভোট দেওয়ার জন্য মুখিয়ে আছেন স্থানীয় ভোটাররাও। সুনামগঞ্জে বিএনপি, জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন, এনসিপি, গণঅধিকার পরিষদসহ বিভিন্ন দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা হাটে-ঘাটে-মাঠে গিয়ে নানান প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোট প্রার্থনা করছেন। তবে আওয়ামী লীগের পতনের পর থেকে বিএনপির কর্মকাণ্ডে অনেকটাই নাখোশ স্থানীয় ভোটারদের অনেকে। তারা সৎ, পরোপকারী ও দুর্নীতিমুক্ত ব্যক্তিকে চান, যিনি এলাকার অবকাঠামোর উন্নয়ন এবং মানুষের জানমালের নিরাপত্তার জন্য কাজ করবেন।
দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সিলেট বিভাগের একটি সীমান্তবর্তী জেলা সুনামগঞ্জ, যা প্রাকৃতিক নিসর্গ টাঙ্গুয়ার হাওর, শিমুল বাগান ও পর্যটন শিল্পের জন্য বিখ্যাত। জেলায় ১২টি উপজেলা, চারটি পৌরসভা এবং ৮৮টি ইউনিয়ন রয়েছে। পাঁচটি সংসদীয় আসন নিয়ে গঠিত এই জেলা।
সুনামগঞ্জ-১:
ধর্মপাশা, তাহিরপুর, মধ্যনগর ও জামালগঞ্জ উপজেলা নিয়ে গঠিত আসনটি। মোট ভোটার ৪,৮০,৯৯২ জন। পুরুষ ভোটার ২,৪৪,৩৪৭ ও নারী ভোটার ২,৩৬,৬৪০ জন। ১৮-৩৫ বছর বয়সী তরুণ ভোটার ২,১৩,০০৫ জন। আসনটিতে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে চারজন প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। জামায়াত ও এনসিপিসহ অন্যান্য ইসলামিক দলে একজন সম্ভাব্য প্রার্থী রয়েছেন। বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে কামরুজ্জামান কামরুল (৪৫) ও আনিসুল হকের (৪৮) যথেষ্ট জনপ্রিয়তা ও কর্মী সমর্থন রয়েছে। দুজনের যে কেউ বিএনপি থেকে মনোনয়ন পেতে পারেন। জামায়াতের প্রার্থী হিসেবে মাওলানা তোফায়েল আহম্মেদ খান (৫৫) প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন বলে জানা গেছে।
সুনামগঞ্জ-২:
আসনটি দিরাই ও শাল্লা উপজেলা নিয়ে গঠিত। মোট ভোটার ৩,০৩,২৫১ জন। পুরুষ ভোটার ১,৫২,৯৯৭ ও নারী ভোটার ১,৫০,২৫৩ জন। ১৮-৩৫ বছর বয়সী তরুণ ভোটার ১,৩০,২৫১ জন। আসনটিতে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে তিনজন, জামায়াত, অন্যান্য ইসলামী দল ও এনসিপিতে একজন সম্ভাব্য প্রার্থী রয়েছেন। বিএনপি সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে নাসির উদ্দিন চৌধুরী (৭৮) ও জামায়াতের প্রার্থী হিসেবে মো. শিশির মনিরের (৪৪) যথেষ্ট জনপ্রিয়তা ও কর্মী সমর্থন রয়েছে।
সুনামগঞ্জ-৩:
আসনটি শান্তিগঞ্জ ও জগন্নাথপুর উপজেলা নিয়ে গঠিত। মোট ভোটার ৩,৬৭,২২৩ জন। পুরুষ ভোটার ১,৮৫,৭২১ ও নারী ভোটার ১,৮১,৪৯৬ জন। ১৮-৩৫ বছর বয়সী তরুণ ভোটার ১,৫৪,১৭০ জন। আসনটিতে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে দুজন, জামায়াত, অন্যান্য ইসলামী দল ও এনসিপি থেকে একজন করে প্রার্থী প্রচার-প্রচারণাসহ মাঠে সক্রিয় আছেন। বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে কয়ছর এম আহমেদ (৬২) ব্যাপক প্রচারণা চালাচ্ছেন। জামায়াতের প্রার্থী হিসেবে ইয়াসিন খান (৪৩) এবং বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের প্রার্থী হিসেবে মাওলানা শাহিনুর পাশা চৌধুরী (৫৬) প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন বলে জানা গেছে।
সুনামগঞ্জ-৪:
আসনটি সদর ও বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা নিয়ে গঠিত। মোট ভোটার ৩,৬৩,৯২৩ জন। পুরুষ ভোটার ১,৮৪,৪৬২ ও নারী ভোটার ১,৭৯,৪৪৮ জন। ১৮-৩৫ বছর বয়সী তরুণ ভোটার ১,৫৮,০১৪ জন। আসনটিতে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে তিনজন, জামায়াত, অন্যান্য ইসলামী দল ও এনসিপি থেকে একজন করে প্রার্থী প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন।
বর্তমানে মাঠে সক্রিয় রাজনৈতিক দলের প্রার্থীদের মধ্যে বিএনপি প্রার্থী হিসেবে দেওয়ান জয়নুল জাকেরিন (৭৭) এবং নুরুল ইসলাম (৪৮) উভয়েরই যথেষ্ট জনপ্রিয়তা ও কর্মী সমর্থন রয়েছে। দুজনের যে কেউ বিএনপি থেকে মনোনয়ন পেতে পারেন। জামায়াতের প্রার্থী হিসেবে মুহাম্মদ শামসুদ্দীন (৬১) এবং জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবে পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ (৫৫) প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন।
সুনামগঞ্জ-৫:
আসনটি ছাতক ও দোয়ারাবাজার উপজেলা নিয়ে গঠিত। মোট ভোটার ৫,০১,৮১৪ জন। পুরুষ ভোটার ২,৫৫,৭৮০ ও নারী ভোটার ২,৪৬,০৩৩ জন। ১৮-৩৫ বছর বয়সী তরুণ ভোটার ২,১০,৯৬০ জন। আসনে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে দুজন, জামায়াত, অন্যান্য ইসলামী দল ও এনসিপি থেকে একজন করে প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। বিএনপির প্রার্থী হিসেবে কলিম উদ্দিন আহমেদ মিলন (৫৮) এবং মো. মিজানুর রহমান চৌধুরীর (৫৪) জনপ্রিয়তা যথেষ্ট। তাদের কর্মী সমর্থনও রয়েছে। দুজনের যে কেউ বিএনপি থেকে মনোনয়ন পেতে পারেন। জামায়াতের প্রার্থী হিসেবে অধ্যক্ষ আব্দুস সালাম আল মাদানী (৬৬) এ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন।
আসনগুলোতে বিএনপি সাংগঠনিক তৎপরতার পাশাপাশি দলীয় ৩১ দফা সংবলিত লিফলেট বিতরণসহ বিভিন্ন কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু জলমহাল, বালুমহালে চাঁদাবাজি, অন্তকোন্দল ও মামলা বাণিজ্য ইত্যাদির কারণে সাধারণ ভোটারদের মাঝে কিছুটা নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া রয়েছে। ফলে আসন্ন নির্বাচনে ভোটাররা ক্লিন ইমেজ, সৎ ও যোগ্য প্রার্থী দেখে ভোট দিতে চান। যারা দীর্ঘদিন ধরে এলাকায় কাজ করেছেন, মানুষের বিপদে আপদে পাশে থেকেছেন তাদেরকেই তারা ভোট প্রদান করবেন।
দোয়ারাবাজার সরকারি ডিগ্রি কলেজের ছাত্র তানভীর আহমেদ মনে করেন- বিগত দিনের নির্বাচনগুলোতে যে অনিয়ম, দুর্নীতি ও সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে তার পুনরাবৃত্তি যেন না হয় সেজন্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সতর্ক থাকাতে হবে। তরুণদের ভোটের মাধ্যমে আগামীর নির্বাচনে যারা বিজয়ী হবেন তারা যেন অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে সুশৃংখলভাবে দেশ পরিচালনার অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
জগন্নাথপুর উপজেলার বশির আহমেদ নামক একজন ব্যবসায়ী বলেন, অনেক নির্বাচন দেখেছি। যে নির্বাচনগুলো অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়নি। তাই অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে এমন একটি নির্বাচন আয়োজন করতে হবে যেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সহিংসতাজনিত ঘটনা না ঘটে, পেশিশক্তি ও দলীয় প্রভাব মুক্ত সুষ্ঠু পরিবেশ থাকে, জাল ভোট প্রদানের প্রবণতাসহ কারচুপি না হয়। সাধারণ ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে গিয়ে যেন নির্বিঘ্নে যোগ্য প্রার্থীকে ভোট প্রদানের মাধ্যমে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারেন আমি সেই আশা করি।
সুনামগঞ্জ কোর্টের আইনজীবী সাইদুর রহমান বলেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু, স্বচ্ছ, অবাধ, নিরপেক্ষ ও দেশে-বিদেশে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয় সেভাবে নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা, টেকসই উন্নয়ন, মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের উপর নির্ভরশীল। গণতান্ত্রিক উপায়ে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন আয়োজন করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার পরিবেশ রক্ষা আন্দোলনের সেক্রেটারি ফজলুল করিম বলেন, আমরা উৎসবমুখর, সুষ্ঠু, অবাধ, স্বচ্ছ, গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চাই। পাশাপাশি এমপি হিসেবে আমরা এমন একজন ব্যক্তিকে চাই যিনি দুর্নীতিমুক্ত, সৎ ও হাওরাঞ্চলের পিছিয়ে পড়া শিক্ষা ব্যবস্থা, চিকিৎসা, রাস্তাঘাট ও মানুষের ভাগ্যের উন্নয়নে কাজ করবেন। হাওর এলাকার কৃষি, কৃষক ও শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের জন্য কাজ করবেন। সর্বোপরি আমাদের সুখে-দুঃখে পাশে থাকবেন।
জামালগঞ্জ উপজেলার কৃষক লাল মিয়ার মতে, তিনি দেশে উৎসবমুখর, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চান। এছাড়াও তিনি এমপি হিসেবে একজন সৎ ও দুর্নীতিমুক্ত ব্যক্তিকে ভোট দিতে চান, যিনি ব্যক্তি সব সময় সুখে-দুঃখে মানুষের পাশে থাকবেন এবং কৃষক, শ্রমিক সব পেশাজীবী মানুষের ভাগ্যের উন্নয়নে কাজ করবেন।
তাহিরপুর উপজেলা সদর বাজারের ব্যবসায়ী রুবেল মিয়ার মতে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেশে-বিদেশে সবার কাছে নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হতে হবে। ভোটাররা নির্ভয়ে পছন্দে প্রার্থীকে ভোট দিতে পারবেন। এমপি হিসেবে তিনি সৎ, পরোপকারী ও দুর্নীতিমুক্ত ব্যক্তিকে চান, যিনি এলাকার অবকাঠামোর উন্নয়ন এবং মানুষের জানমালের নিরাপত্তার জন্য কাজ করবেন।
দিরাই উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক মাহমুদুল হাসান বলেন, একটি অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন করতে হবে, যেন সাধারণ ভোটাররা নির্বিঘ্নে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেন। তার প্রত্যাশা- নির্বাচনে যোগ্য ও দুর্নীতিমুক্ত প্রার্থী নির্বাচিত হয়ে অনিয়ম, দুর্নীতি, বেকারত্ব দূরীকরণ এবং দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করে দেশ পরিচালনায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করবেন।







