বিশখালী নদীর চরে প্রকৃতির নৈসর্গ সাজিয়েছে ছইলার চর। প্রকৃতির অকৃপণ রূপ-লাবণ্যে ঘেরা এই পর্যটন এনে দিতে পারে অপার সম্ভাবনা। এই অঞ্চলটি যেন প্রকৃতির অপূর্ব সৌন্দর্যের আঁচলে ঢাকা। যেখানে পর্যটকরা মুগ্ধ হন, প্রেমে পড়েন শীতল প্রকৃতির এই লীলাভূমিতে। এখানকার প্রাকৃতিক শোভা অতি সহজে মুগ্ধ করে যে কাউকে।
বরিশালের কাঠালিয়া উপজেলার বিশখালী নদী তীরে ৪১ একর জমি নিয়ে জেগে ওঠা বিশাল চরে রয়েছে প্রায় লাধিক ছইলা গাছ। আর এ গাছের নাম থেকেই জেগে ওঠা নদী চরের নামকরণ করা হয়েছে ছইলার চর। কিছুদিন আগেও যেখানে জমি দখল করে চাষাবাদ, বন উজাড় করে কাঠ ইটভাটায় চালান,নদীর ভাঙ্গন, পর্যটকদের নানামুখী দুর্ভোগ সহ গো-চারন ভূমিতে পরিনত হয়ে অস্তিত্ব সংকটে পরেছিল সম্ভাবনাময় এই পর্যটন কেন্দ্রটি।
অতিসম্প্রতি সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, কাঠালিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুফল চন্দ্র গোলদারের দিন রাত নিরলস পরিশ্রমে ছইলারচর ফিরে পেয়েছে তার অস্তিত্ব। রুপান্তর হচ্ছে আধুনিক পর্যটনকেন্দ্রে। ছইলারচরকে একটি সৌন্দর্যপূর্নভাবে মানুষের চিত্ত বিনোদনের জন্য গড়ে তুলতে সকল সংকট দূর করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। ইতিমধ্যে এ পর্যটন কেন্দ্রে রং-বেরংয়ের ছোট ছোট সেতু, বসার জন্য পাকা বেঞ্চ নির্মান, ফাকা জমিতে বৃক্ষ রোপন, থাকার জন্য কটেজ নির্মান, অধুনিকয়ন করতে সৌর-বিদ্যুতের সংযোগ, রাতের জ্যোৎস্না উপভোগ করতে গোলঘর স্থাপন, চরে যাওয়ার জন্য নৌকা ও চরে ওঠা-নামার জন্য ঘাটলার ব্যবস্থা,সড়ক পথে চরে যাওয়ার জন্য সেতু নির্মান সহ বিভিন্ন কাজ সম্পন্ন এবং একাধিক প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। তার নানামুখী উদ্দ্যেগের ফলে অপরিমেয় সৌন্দর্যবিস্তৃত এই পর্যটন কেন্দ্র কর্মব্যস্ত মানুষেরা পরিবার-পরিজন নিয়ে একটু বিনোদনের জন্য ছুটে আসেন।
এছাড়াও সুন্দরবনের আদলে গড়ে ওঠা দৃষ্টিনন্দন এই বনে ছইলা ছাড়াও কেয়া, হোগল, রানা, এলি, মাদার, আরগুজিসহ বিভিন্ন প্রজাতের গাছ রয়েছে। এসব গাছে বিভিন্ন পাখি নীড় বেঁধেছে। পুরো চরজুড়ে বিচিত্র রকমের পাখির কলকাকলি পর্যটকদের মনছুঁয়ে যায়। একদিকে বিস্তীর্ণ বিশখালী নদীর হাতছানি, অন্যদিকে অকৃত্রিম বনের মাঝে ছড়িয়ে থাকা সবুজের সমারোহ যেন দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করে। উপজেলা প্রশাসনের নিরলস প্রচেষ্ঠার ফলে ছইলারচর এখন গোটা দক্ষিঞ্চলের একটি উল্লেখযোগ্য পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। পর্যটকদের আকৃষ্ট করে সমৃদ্ধ হতে শুরু করছে এখানকার অর্থনীতি।
রং-বেরংয়ের ছোট ছোট সেতু নির্মাণ ॥ বনের ভেতর বন আর নদীর বিশাল জলরাশি দর্শনের লক্ষে কাঠ ও বাশ দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে ছোট ছোট রং-বে রংয়ের সেতু। সেতু নির্মাণের কারণে বনের ভেতর পায়ে হেঁটে প্রকৃতিপ্রেমী মানুষ নিরাপদে ও স্বাচ্ছন্দে বনের প্রকৃতি দর্শনের সুযোগ পাচ্ছেন। বিশখালীর নদীর কোল ঘেঁষা ছইলার চর পর্যটন কেন্দ্রের ভেতর ছোট পাঁচমিশালী রংয়ের সেতু দর্শনার্থীদের নিসর্গ মায়ায় টানছে।
বসার জন্য পাকা বেঞ্চ ও গোলঘর নির্মান ॥ দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসা ভ্রমন পিপাসুদের বসার জন্য বনের বিভিন্ন ফাঁকা অংশে নির্মান করা হয়েছে পাকা বেঞ্চ। সেই সাথে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সূর্যাস্তের পর রাতের জ্যোৎস্না উপভোগ করার জন্য নদীর পারে বিভিন্ন স্থানে ছন,বাঁশ ও গোলপাতা দিয়ে গোলঘর স্থাপন করা হয়েছে। পড়ন্ত বিকেলে নদী তীরে বসে ট্রলার, লঞ্চসহ জেলে নৌকার ছোটাছুটি উপভোগ করতে পারবে পর্যটকরা। এগুলোর নাম দেওয়া হয়েছে “শীতল পরশ”।
ফাঁকা জমিতে বৃক্ষ রোপন ॥ বনের সৌন্দর্য বৃদ্ধির লক্ষে বনের ফাঁকা অংশে ফুল, ফল ও ঔষাধী সহ বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষ রোপন করা হয়েছে। বনের ভিতরের ফাঁকা অংশে এখন রং বে রংয়ের নানান প্রকার ফুলের সমহার রয়েছে। যা পর্যটকদের আরো দৃষ্টি কাড়ছে।
পর্যটকদের রাতযাপনের জন্য দৃষ্টিনন্দন কটেজ ॥ দেশি ও বিদেশি পর্যটকদের রাতযাপনের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে একটি দৃষ্টিনন্দন কটেজ নাম “ধানসিড়ি”। আরো কয়েকটি কটেজের কাজ চলমান রয়েছে। এছাড়াও গ্রামীন পরিবেশে তৈরি করা হবে কাঠ বাশের ব্যাতিক্রমী কিছু কটেজ। ইট- কংক্রিটের দালানের আড়ালে আকাশ ঢাকা পড়লেও দৃষ্টিনন্দন এ কটেজে বসেই পর্যটকদের আকাশের সঙ্গে মিতালিতে মন ছুয়ে যাবে গ্রামের অনুভূতিতে।
লেকের ওপর তৈরি হবে সেতু ॥ সড়ক পথে ছইলারচরে প্রবেশ করার এখনও তেমন কোন ব্যবস্থা করা হয়নি। তবে অতি সম্প্রতি চর থেকে ছইলার চরে যাওয়ার জন্য একটি সেতু তৈরির কাজ চলছে। ইতিমধ্যে সেতুটি দৃশ্যমান হয়েছে।
লেকে ঘুরে বেড়ানোর জন্য থাকবে আধুনিক জলযান ॥ ছইলার চরের এক পাশে নদী অন্য পাশে ডিসি ইকোর্পাকে রয়েছে একটি লেক যার নাম দেওয়া হয়েছে“ ডিসি লেক” এই লেক ও নদীতে ঘুরে আনন্দ উপভোগের জন্য সংযোজন করা হবে আধুনিক জলযান। ইতিমধ্যে লেক পারাপারের জন্য ময়ূরপঙ্খি নামে দুটি নৌকা দেওয়া হয়েছে।
ছোটদের জন্য কিডস জোন॥ বড়দের পাশাপাশি ছোটদেরকেও পর্যটন কেন্দ্রে আকৃষ্ট করতে নির্মান করা হবে কিডস জোন। যেখানে বিভিন্ন প্রকার রাইডস সহ নানান খেলনা সামগ্রী। ফলে নয়নাভিরাম সৌন্দর্যমন্ডিত এ পর্যটন কেন্দ্রটিতে পরিবারের সাথে আনন্দে মেতে উঠবে শিশুরাও।
নির্মান কাজ শুরু হয়েছে নজরকাড়া “ডিসি ইকোপার্ক”॥ ছইলার চরের পাশেই ৫ একর জমিতে গড়ে তোলা হচ্ছে দৃষ্টিনন্দন ডিসি ইকোপার্ক। জেলার প্রত্যন্ত উপজেলা কাঠালিয়ায় এই প্রথম একটি আধুনিক পার্ক হচ্ছে।
উপজেলা প্রসাশনের অর্থায়নের নির্মিত এ পার্কের নাম দেওয়া হয়েছে ‘ডিসি ইকোপার্ক’। ইতিমধ্যেই এখানে প্রায় ১ একর জমিতে খনন করা হয়েছে ডিসি লেক আর লেকের উপর গোলঘর তৈরি করা হয়েছে। ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হতে চলছে পার্কটি। এছাড়াও এখানে থাকবে দেশি ও বিদেশি পর্যটকদের রাতযাপনের জন্য থাকবে দৃষ্টিনন্দন কটেজ । লেকের ওপর তৈরি হবে সেতু, লেকে ঘুরে বেড়ানোর জন্য থাকবে আধুনিক জলযান, বন্য প্রাণী সংরক্ষণে থাকবে মিনি চিড়িয়াখানা আর ছোটদের জন্য কিডস জোন। নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পার্কটি দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে।
করোনার মধ্যে ছইলার চরে স্ব-পরিবারে ঘুরতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উপসচিব ও কক্সবাজারের সাবেক জেলা প্রশাসক কামাল হোসেন ও তার স্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক-৪ গুলশান আরা বেগম বলেন, দীর্ঘদিন পর প্রকৃতির প্রকৃত সাধ পেলাম এখানে। এতো মনোরম পরিবেশে পর্যটনের জন্য এর চেয়ে আর ভাল স্থান হয়না। এটা পর্যটন আয়ের উৎস হতে পারে বলে উল্লেখ করে তারা করে বলেন, আগামীতে এই পর্যটন কেন্দ্রকে ঘিরে প্রায় শতাধিক লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হতে পারে।
ঘুরতে আসা পর্যটক ইসরাত জাহান মিম বলেন, আমাদের পাশের যে কয়টি উপজেলা আছে, সেগুলোতে তেমন কোনো বিনোদন কেন্দ্র নেই। শিশু-কিশোর ও শির্থীদের বিনোদনের জন্য যেতে হয় জেলা শহরের বাইরে। ছইলার চরের পাশাপাশি ডিসি ইকোপার্ক প্রতিষ্ঠা পেলে পাল্টে যাবে এখানকার চিত্র। পার্কটি চালু হলে রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পাবে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুফল চন্দ্র গোলদার বলেন, অপরূপ সৌন্দর্য্যের লীলাভূমি ছইলারচর। পর্যটন ক্ষেত্রে দক্ষিনাঞ্চলের অন্যতম আকর্ষণ হিসেবে গড়ে তোলা হবে এটিকে। এর পরিচিতি শুধু দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত করা হবে। দেশি বিদেশি পর্যটকদের সমাগম বাড়লে স্থানীয় রকমারি পণ্যের চাহিদা বাড়বে। তিনি আরও বলেন, ছইলার চরটি পর্যটন সম্ভাবনার হাতছানি। বর্তমানে এখানে পর্যটকদের জন্য বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা তৈরি করা হয়েছে। এছাড়াও সংশ্লিষ্ট প্রশাসন থেকে পর্যটন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়ে আবেদন করা হয়েছে। ইতোমধ্যে ট্যুরিজম বোর্ড ছইলার চর উন্নয়নের লক্ষ্যে কোটি টাকার প্রকল্প প্রস্তাব করেছে। যা বর্তমানে মন্ত্রণালয়ে অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। এ প্রকল্পটি অনুমোদনের পর বাস্তবায়ন করা হলে ছইলার চরটি হতে পারে দণিাঞ্চলে মধ্যে অন্যতম একটি দর্শনীয় স্থান।