শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৬:৪২ পূর্বাহ্ন

কম-শর্করার পথ্য (কিটো ডায়েট) কি মৃত্যু ঝুঁকি বাড়ায়? প্রমাণ-নির্ভর বিজ্ঞান কী বলে?

বর্তমানকণ্ঠ ডটকম / ৪৫ পাঠক
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৬:৪২ পূর্বাহ্ন

ডাঃ ইসমত কবীর, বর্তমানকন্ঠ ডটকম, ইংল্যান্ড :  (Keto Diet and Evidence Based Medicine) ইউরোপিয়ান সোসাইটি অব কার্ডিওলজিস্টস (ESC) হচ্ছে ১৫০টিরও বেশী দেশের হৃদরোগ সংক্রান্ত স্বাস্থ্য পেশাজীবিদের সবচেয়ে বড় আন্তর্জাতিক সংগঠন।

ইএসসি’র বার্ষিক সম্মেলন বা কংগ্রেস হৃদরোগ বিশেষজ্ঞদের সবচেয়ে বড় ও প্রভাবশালী সম্মেলন। এখানে উপস্থাপিত বৈজ্ঞানিক নিবন্ধের আলোকে বিভিন্ন হৃদরোগ ব্যবস্থাপনার নীতিমালা বা গাইডলাইন তৈরি হয়, পরবর্তীতে বিশ্বের অধিকাংশ দেশের চিকিৎসকগণ নীতিমালা অনুসরণ করেন।

২০১৮ সালে আগষ্ট মাসের ইএসসির সম্মেলনে লো-কার্ব ডায়েটের উপর একটা বড় গবেষণার ফল উপস্থাপন করা হয়। এতে পরিষ্কারভাবে প্রতীয়মান হয়, দীর্ঘ মেয়াদে লো-কার্ব ডায়েটগুলো বিপদজনক আর তাই এগুলো এড়িয়ে চলা উচিত।

গবেষণার ফল ব্যাখ্যা করে পোল্যান্ডের লডজ মেডিকেল ইউনিভার্সিটির গবেষক প্রফেসর ম্যাকিয়েজ বানাচ বলছেন: “আমরা দেখছি যাঁরা লো-কার্ব ডায়েট বা কম শর্করার খাবার গ্রহণ করেছিলেন তাঁদের অকাল মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি ছিল। শুধু তাই না, আলাদা করে করোনারি হার্ট ডিজিজ বা হৃদরোগ, স্ট্রোক এবং ক্যান্সার – এগুলোতে মৃত্যুর ঝুঁকিও ছিল বেশি। তাই এই ডায়েটগুলি এড়িয়ে চলা উচিত।”

স্থুলতা বা মেদবাহুল্য দুনিয়াজুড়ে একটি বড় স্বাস্থ্য সমস্যা। অতিরিক্ত ওজন হৃদরোগ, স্ট্রোক, উচ্চ রক্তচাপ, টাইপ টু ডায়াবেটিস এবং ক্যান্সারসহ বেশ কয়েকটি দীর্ঘস্থায়ী রোগের ঝুঁকি তৈরি করে।

ওজন কমানোর জন্য বিভিন্ন রকম ডায়েটের পরামর্শ দেওয়া হয়। এর মধ্যে একটি হলো, ‘লো-কার্ব’ ডায়েট বা কম শর্করাসহ বেশি আমিষ ও বেশি চর্বি সমৃদ্ধ খাবার। আমাদের দেশে বহুল আলোচিত ‘কিটো ডায়েট’ ‘লো-কার্ব’ ডায়েটগুলোর মধ্যে একটি। এই ডায়েটের দীর্ঘমেয়াদী সুরক্ষা নিয়ে এতোকাল বিতর্ক ছিল৷

আগের গবেষণাগুলোতে হৃদরোগ বা স্ট্রোক, ক্যান্সার এবং মৃত্যুর ঝুঁকিতে ‘লো-কার্ব’ ডায়েটের প্রভাব নিয়ে পরস্পর-বিরোধী ফল দেখানো হয়েছিলো।

নিয়ম অনুসারে খাবারে শক্তির উৎস বা ক্যালোরির ৫০ থেকে ৫৫ ভাগ আসা উচিত কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা থেকে। এর পরিমাণ যদি বিশ ভাগের কম হয় তাহলে একে ‘লো-কার্ব ডায়েট’ বা কম শর্করার পথ্য বলতে পারি।

এবারের গবেষণায় মার্কিন জাতীয় স্বাস্থ্য ও পুষ্টি জরিপ (National Health and Nutrion Examination Survey) এর ২৪,৮২৫ জন অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ‘লো-কার্ব’ বা কম শর্করার ডায়েট এর সাথে যে কোন কারণে মৃত্যু এবং করোনারি হার্ট ডিজিজ বা হৃদরোগ, সেরিব্রোভাসকুলার ডিজিজ (স্ট্রোক সহ) এবং ক্যান্সারের মধ্যকার সম্পর্কের সম্ভাবনা পর্যালোচনা করা হয়েছে (১৯৯৯ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত) । এতে দেখানো হয়, ‘লো-কার্ব’ ডায়েট অনুসারীদের যে কোন কারণে মৃত্যু ৩২℅ বেশি। করোনারি হার্ট ডিজিজ (হৃদরোগ), সেরিব্রোভাসকুলার ডিজিজ (স্ট্রোক) এবং ক্যান্সারের কারণে মৃত্যুর ঝুঁকি যথাক্রমে ৫১%, ৫০% এবং ৩৫% বেড়েছে।

যারা মেদবাহুল্য বা স্থুলতায় ভুগছেন না অথচ লো-কার্ব ডায়েটের অনুসারী ছিলেন আর যারা বয়স্ক তাঁদের মধ্যে এ ঝুঁকির প্রবণতা ছিল বেশি।

NHANES এর গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের গড় বয়স ছিল ৪৭.৬ বছর, এবং ৫১% ছিলেন নারী।

পরবর্তীতে সাতটি বড়সড় সমীক্ষা ও গবেষণা নিয়ে একটি অধি-বিশ্লেষণ (Meta-analysis) করা হয়। এতে ছিলেন মোট ৪৪৭,৫০৬ জন অংশগ্রহণকারী এবং গড়পড়তা ১৫.৬ বছর ধরে এদের অনুসরণ করা হয়। এতে পাওয়া গেছে, লো-কার্ব ডায়েট অনুসারীদের হৃদরোগ, স্ট্রোক ও ক্যান্সারে অতিরিক্ত মৃত্যু ঝুঁকি হচ্ছে যথাক্রমে ১৫%, ১৩%, এবং ৮%।

অধ্যাপক বানাচ বলেছেন: “কম শর্করার ডায়েটগুলি ওজন কমাতে, রক্তচাপের উন্নতি করতে এবং রক্তে গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণ করতে স্বল্পমেয়াদে কার্যকর হতে পারে তবে এ গবেষণায় বোঝা যায় যে দীর্ঘমেয়াদে এগুলি সরাসরি মৃত্যু-ঝুঁকির সাথে যুক্ত রয়েছে এবং এতে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ (হৃদরোগ), সেরিব্রোভাসকুলার ডিজিজ (স্ট্রোক) এবং ক্যান্সার।

কম-শর্করা ডায়েট এবং মৃত্যুর মধ্যে সম্পর্কের কারণ সম্পর্কে অধ্যাপক বানাচ বলেছেন, প্রাণীজ প্রোটিন, বিশেষত লাল এবং প্রক্রিয়াজাত মাংস ক্যান্সারের ঝুঁকির সাথে সম্পৃক্ত বলে প্রমাণ রয়েছে। তিনি আরও বলেছেন, ফাইবার এবং ফল কম খেলে প্রাণীজ আমিষ, কোলেস্টেরল এবং স্যাচুরেটেড ফ্যাট গ্রহণের পরিমাণ বেড়ে যায়। এতে করে খনিজ, ভিটামিন এবং ফাইটোকেমিক্যালগুলি গ্রহনের তারতম্যও ঘটে। এ ব্যাপারটাও উল্লেখযোগ্য কারণ হতে পারে।

একই মাসে চিকিৎসা সাময়িকী ল্যানসেট এ প্রকাশিত আরেকটি বড় অধি-বিশ্লেষনে (Meta-analysis) শর্করা গ্রহণের সাথে মৃত্যু ঝুঁকির সম্পর্ক দেখানো হয়েছে। লো-কার্ব ডায়েট হচ্ছে সবচেয়ে বেশী ঝুঁকির, তারপর রয়েছে হাই-কার্ব ডায়েট।

https://www.thelancet.com/journals/lanpub/article/PIIS2468-2667(18)30135-X/fulltext

এখানে উল্লেখ্য, চিকিৎসা বিজ্ঞানের সেরা পাঠ্যপুস্তকগুলোর কোনটাতেই ওজন কমানোর জন্য দীর্ঘ মেয়াদি লো-কার্ব ডায়েটের কথা বলা হয় নি।

যুক্তরাজ্যের ডায়েবেটিক সমিতি কিছু লো-কার্ব ডায়েটের ব্যাপারে জনগণকে সতর্ক করে দিয়েছে।

ইএসসির গবেষণার বিস্তারিত মিলবে এখানেঃ

https://www.escardio.org/The-ESC/Press-Office/Press-releases/Low-carbohydrate-diets-are-unsafe-and-should-be-avoided

লেখক – এমবিবিএস, এমফিল (ফার্মাকোলজি), এমআরসিপি (ইউকে), এমআরসিপিএস (গ্লাসগো) জেরিয়াট্রিক ও জেনারেল মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস, ইংল্যান্ড। 


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *