ডা.বতুল রহমান, বর্তমানকন্ঠ ডটকম :আমার মনে পড়ে, ১৯৮৩-৮৪ সালে আব্বার চাকুরির সুবাদে আমরা কুষ্টিয়াতে। বাসা কুষ্টিয়া সরকারী কলেজের বিপরিতে। ৭-ই মার্চে ভোরে কলেজের মাঠ থেকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ মাইকে বাজছিলো। আমরা বাসা থেকেই শুনতে পেলাম। হঠাৎ করেই থেমে গেল। তারপরই ধাওয়া- পাল্টা ধাওয়ার হৈচৈ। আর শোনা হলো না। পরে আর কোথাও শোনার কোন সুযোগ ছিল না। এভাবেই থামিয়ে দেয়া হয়েছিলো। কণ্ঠ রোধ করা হয়েছিলো সু-পরিকল্পিতভাবে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট, এই দিনে ধানমন্ডির একটি সিড়িতে মুখ থুবড়ে পড়েছিলো বাংলাদেশ। পথ হারিয়েছিলো বাংলাদেশ। স্বাধীন বাংলাদেশর সবচেয়ে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ ঘটেছিলো। স্বাধীনতা-বিরোধী চক্র সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী উচ্ছৃঙ্খল সদস্য সূর্য ওঠার আগেই খুব ভোরে ধানমন্ডির বাসভবনে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করেছিলো। ঘাতকের নির্মম বুলেটে সেদিন ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের ঐতিহাসিক ভবনে শাহাদাত বরণ করেছিলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
এরপর সেই খুনিরা উল্লাস করেলো। পরবর্তীতে গঠিত রাষ্ট্র খুনিদের বিচার না করে পুরষ্কৃত করেলো। স্বীকৃত রাজাকারদের গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা উড়লো। মুক্তিযুদ্ধের উল্টো পথে চললো রাষ্ট্র। থমকে যায় উন্নয়নের ধারা।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর শাসকগোষ্ঠী সচেতনভাবে সমকালীন শিল্পসাহিত্য থেকেও বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে দিতে চেয়েছিল। ফলে এ সময়ে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কিছু লেখা কারোর পক্ষেই সহজ কাজ ছিল না। ইতিহাস থেকে মুছে দেয়ার চেষ্টা চললো শেখ মুজিবের নাম, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, মুক্তিযোদ্ধাদের গল্প-কথা। ১৯৭৫ এর পর আর শোনা যায়নি ৭ই মার্চের ভাষণ।
একাত্তর-পঁচাত্তর সমসাময়িক বা ঐ সময়ের কিছু আগে বা পরে যাদের জন্ম, তারা জানতে পারলো না মুক্তিযুদ্ধের কথা, জানতে পারলো না কত রক্তের বিনিময়ে, কত মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে এই বাংলাদেশ এবং এই পতাকা আমরা পেয়েছি। স্বাধীন দেশের সন্তানদেরকে শেখানো হলো বিকৃত ইতিহাস।
যারা প্রকৃত কাহিনী জানতো, কেউ মুখ খুলতে পারলো না হায়ানাদের ভয়ে। এদের অনেকেই বিপথে চলে গেল। অনেক রাজাকার এবং তাদের দোসরেরা সেদিন পতাকার দিকে তাকিয়েছিলো কবে পাকিস্তানের পতাকা তোলা হবে। বাংলাদেশ বেতারের নাম পরিবর্তন করে করা হয় রেডিও বাংলাদেশ (রেডিও পাকিস্তানের অনুকরণে), রাষ্ট্রীয় স্লোগান জয় বাংলা থেকে করা হয় বাংলাদেশ জিন্দাবাদ (পাকিস্তান জিন্দাবাদের অনুকরণে), পাকিস্তানের সাথে আবার কনফেডারেশনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে বাংলাদেশ।
ঘাতকরা কি শুধু ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার জন্য ১৫ আগষ্ট ঘটিয়েছিল ? না, তারা হত্যা করতে চেয়েছিল অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশকে, তারা হত্যা করতে চেয়েছিল আমাদের মহান মুক্তিযোদ্ধের চেতনাকে। তারা চেয়েছিল বাংলাকে পাকি রাষ্ট্র বানাতে।
অথচ আমরা কি কখনও ভেবেছি, আজ সারাবিশ্বে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে যে যেখানেই আছি, যা ভাবছি, যা বলছি, যা কিছু করছি, কোনটাই সম্ভব হত না —- যদি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম না হত। যদি উনি তাঁর রাজনৈতিক জীবনে ৪ হাজার ৬৮২ দিন কারাভোগ করেতেন। এর মধ্যে স্কুলের ছাত্র অবস্থায় ব্রিটিশ আমলে সাত দিন কারা ভোগ না করতেন। যদি আমাদের ইতিহাসের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় সময়টাতে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার স্বপ্ন না দেখাতেন। জীবন-মরণের সন্ধিক্ষণে যদি স্বাধীনতার ডাক না দিতেন। যদি নয় মাস পাকিদের কারাগারে বন্দী না থাকতেন।
যদি না বলতেন। ‘তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’।
অথচ আজ এই স্বাধীন বাংলায় কত আজেবাজে আলোচনা,কত অসততা, কত দুর্নীতি !! আজও কি আমরা ঠিক পথে আসতে পেরেছি ? এখনও অনেক রাজাকার এবং তাদের দোসরেরা এ দেশকে পাকিস্তান মনে করে। এ দেশের খেয়ে পড়ে বিশ্বের কাছে ছোট করবার জন্যে উঠে পড়ে লেগে আছে। দেশ বিরোধী তখনও ছিল, এখনও আছে। দুর্নীতিবাজরা তখনও ছিল, এখনও আছে।
মানুষ একটু একটু করে মুখ খুলতে শুরু করেছে। একের পর এক সত্য বের হয়ে আসছে। প্রমাণ হয়ে যাচ্ছে মিথ্যা ইতিহাস রচনার কাহিনীগুলো। আমরাও অনেক কিছু জানতাম না। এখন অনেক সত্য চোখের সামনে পরিস্কার।
হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর নাম বাংলাদেশের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এই নামের সাথে কোন রাজনৈতিক দ্বিধাবিভক্তি থাকতে পারে না। এই বাংলাদেশ আমাদের মাতৃভূমি হলে, এই অবিসংবাদিত নেতাকে অবশ্যই যথাযোগ্য সম্মান দিতেই হবে। আমরা যেন এই সকল সঙ্কীর্ণতা থেকে উঠে আসতে পারি। যে বঙ্গবন্ধুকে মূল্যায়ন করতে পারবে না, সে কখনই দেশকে ভাল্বাস্তে পারে না। সঠিক মূল্যায়ন তখনই হবে যখন আমরা দেশের জন্যে কাজ করতে যাবো। শোকের মাসের শোককে শক্তিতে রূপান্তর করে তরুন প্রজম্ম বাংলাদেশকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তুলতে পারলেই তাঁর দেখা স্বপ্নের মত দেশ গড়ে তুলতে পারবো।বঙ্গবন্ধু অমর, মৃত্যুঞ্জয়ী, মৃত্যু নেই তাঁর।
বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকবে বঙ্গবন্ধু প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ! বেঁচে থাকবে জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হয়ে বাংলার ঘরে ঘরে! বেঁচে থাকবে বিশ্বের কছে বিশ্ব নেতার উদাহরণ হয়ে !!
জয় বাংলা !!! জয় বঙ্গবন্ধু !!!