শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৭:১৯ অপরাহ্ন

অতিথি পাখিদের বিচরণ নিরাপদ হোক

এ টি এম মোসলেহ উদ্দিন জাবেদ। / ৬৩ পাঠক
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৭:১৯ অপরাহ্ন

শীতকাল এলেই অতিথি পাখিদের কলকাকলিতে মুখর হয় আমাদের দেশ। আমাদের দেশের প্রায় প্রতিটি জেলাতেই শীতের অতিথি পাখিদের দেখা যায়। শীতকাল এলে শীত প্রধান দেশের পাখিরা দেশভ্রমণে বের হয় বেঁচে থাকার জন্য। মূলত আমাদের দেশে আসে সাইবেরিয়া এবং হিমালয় অঞ্চলের পাখিরা। শীতকাল এলে ওই সব দেশের ভূভাগ ও জলাশয়গুলো বরফে ঢেকে যাওয়ায় সেখানকার পাখিরা, বিশেষ করে সেসব দেশের হাঁস, বক ইত্যাদি জলচর পাখিরা প্রয়োজনীয় খাবার পায় না। তখন তাদের বেঁচে থাকার জন্য তো খাবার প্রয়োজন হয়। শীতপ্রধান দেশের পাখিরা তখন দেশান্তরী হতে শুরু করে। পাড়ি জমায় এমন দেশে যেখানে হাওর-বাওড়, নদী-নালার কোনো অভাব নেই, খাবারের সমস্যা নেই। এমন কয়েকটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের নাম উল্লেখযোগ্য। শীতটা কাটিয়ে আবার ওরা পাড়ি জমায় নিজ দেশে। এরই ভেতর পাখিপ্রেমিকরা মন ভরে দেখে নেয় তাদের।

শীতের মৌসুমে আসা অতিথি পাখিদের মধ্যে রয়েছে বালিহাঁস, পাতিহাঁস, লেজহাঁস, পেরিহাঁস, চমাহাঁস, জলপিপি, রাজসরালি, লালবুবা, পানকৌড়ি, বক, শামুককনা, চখপখিম সারস, কাইমা, শ্রাইক, গাঙ কবুতর, বনহুর, হরিয়াল, নারুন্দি, মানিকজোড়াসহ নাম না-জানা আরো অনেক পাখী। প্রতি বছর বাংলাদেশে প্রায় ১৫ প্রজাতির হাঁস ছাড়াও গাগিনি, গাও, ওয়েল, পিগটেইল, ডাটাস্মক, থাম, আরাথিল, পেরিক্যান, পাইজ, শ্রেভির, বাটান এসব পাখি এসে থাকে। দেশান্তরী এসব পাখির মূল বাসভূমি শীতপ্রধান এলাকা। সাইবেরিয়াসহ হিমালয়ের বনাঞ্চলে এদের বাস। শীত বাড়তেই এরা পাড়ি জমায় হাজার মাইল দূর দেশে। প্রাণী বিজ্ঞানীদের কথায়, বাংলাদেশের পাখি দুই শ্রেণীর। আবাসিক আর অনাবাসিক। অতিথি পাখি অনাবাসিক শ্রেণীর।

আমাদের দেশের প্রায় প্রতিটি জেলায় শীতের এই অতিথি পাখিদের বিচরণ দেখতে পাওয়া যায়। প্রতি বছর শীতের শুরুতেই ওরা আসে ঝাঁকে ঝাঁকে। নানা রং আর আকৃতির অতিথি পাখির কূজনে মুখরিত হয় নদীপাড়, বিল-ঝিল, বন-বাদাড় সব। বাংলাদেশের বেশ কিছু জায়গায় আনা গোনা দেখা যায় তাদের। এর মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস, মিরপুর চিড়িয়াখানা, মিরপুর ক্যান্টনমেন্টের পাশের লেক, মহেশখালী দ্বীপ, পঞ্চগড়ের ভিতরগড়, চরভাটা, শিবালয়, হালহাওর, হাকালুকি হাওর, কুয়াকাটা, ঘাটিভাঙ্গা, কলাদিয়া, চরণদ্বীপ, নিঝুম দ্বীপ, চর ওসমান, শাহীবানীচর, সন্দ্বীপ, চরমনতাজ, নেত্রকোনার কলমকান্দার হাওর, কিশোরগঞ্জ হাওর, সুনামগঞ্জ হাওরহাতিয়া দ্বীপ, চরপিয়া, ডালচর যামিরচর, মৌলভীবাজার, টাঙ্গুয়ার হাওর, চরকুকড়িমুকড়ি, গলাচিপা, খেপুপাড়া, জোনাকচর, বুড়ীগঙ্গা নদী, হোয়াইকিয়ং, শাহপরীর দ্বীপ, মনপুরা, সোনারচর, চরনিজাম, চরমানিক, চরদিয়াল, আগুনমুখা প্রভৃতি।

শীতের অতিথি পাখিগুলো আমাদের দেশে এসে সৌন্দর্য প্রস্ফুটিত করারা পাশাপাশি আমাদের যথেষ্ঠ উপকার সাধন করে। তাই অতিথি পাখিগুলোকে অতিথি মর্যাদা দেয়া উচিত। প্রকৃতির ক্ষতিকর পোঁকামাকড়, কীটপতঙ্গ, ইঁদুর প্রভৃতি খেয়ে ওরা ফসলের ও জলজ প্রাণীদের সুরক্ষা সাধন করছে। কিছু পাখি প্রাণী ও উদ্ভিদের বংশ বিস্তারে সাহয্য করে। গাছের ডালে আশ্রয় নেওয়া পাখিগুলো গাছের ফাঁকে ফাঁকে থাকা পোঁকামাকড় ধরে খায়। ফলে গাছপালা পোঁকার আক্রমন হতে রক্ষা পায়। হাওড়-বাওড়, বিল-ঝিল ও জলাশয়ে পাখিগুলো সাতার কাটায় পানিতে অক্সিজেন মেশার সুযোগ পায় এবং পানির ভারসাম্য রক্ষা পায়। পানিতে মাছের ক্ষতিকর পোঁকা ধরে খায়। এতে মাছের বংশ রক্ষা পায়। তাছাড়া পাখির মলমূত্র, বিষ্ঠা মাঠিতে জমা হয়ে মটিকে ফসফরাস ও ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ করে তুলে। পাখি ও মৎসবিদদের মতে যে হাওড়ে যত বেশি পাখি মুক্তভাবে বিচরণ করবে সে হাওড়ে বা জলাশয়ে মৎস সম্পদ বেশি উৎপন্ন হবে। পৃথিবীর ৮০ শতাংশ পাখিই পোঁকমাকড় খাওয়া পাখি। এই পাখিরাই পোকাঁমাকড় খেয়ে আমাদের মূল্যবান বন-জঙ্গলের বৃক্ষসম্পদগুলোকে বাঁচিয়ে রাখে। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে আমনা এতো বেশি পরিমাণ কীটনাশস ব্যবহার করছি যে, আমাদের চারপাশ থেকে এখন পোঁকামাকড় বিল্প্তু হয়ে আজ নানা প্রজাতির পাখিরাও বিলুপ্ত হতে চলেছে।

বহু বছর ধরে শীত মৌসুমে বাংলাদেশে অতিথি পাখি এলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন কারনে অতিথি পাখি আসাটা কমে যাচ্ছে। এসব পাখির জীবনযাপন ও পরিবেশ দিন দিন অনিরাপদ হয়ে উঠছে। যে পাখিরা শুধু জীবন ও খাদ্যের সন্ধানে আমাদের মতো দেশে আসে; নিজেদের অসচেতনতা ও লোভের বশবর্তী হয়ে কিছু লোক সেই অতিথি পাখিরই জীবন বিনষ্ট করছে বা খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করছে। এমন অমানবিক আচরণ কোনোভাবেই কাম্য নয়। এছাড়াও আমরা বাঙালিরা অতিথি পাখি দেখতে গেলেই পাখির খুব কাছে যেতে চাই, ছবি তুলতে চাই। ক্যামেরার ক্লিক বা নীরবতা ভঙ্গ করলে পাখিরা বিরক্তরোধ করে এবং অন্যত্র চলে যায়। আমরা প্রয়োজনের অতিরিক্ত ক্যামেরায় ক্লিক দিই। একই কারনে অনেক পাখির আবাসস্থলে পাখির সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এ থেকে আমাদের সর্তক হতে হবে। নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। ক্যামেরা বা শব্দযন্ত্রের ব্যবহার প্রয়োজন ছাড়া একেবারেই কমিয়ে আনতে হবে।

২০১২ সালের বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন অনুযায়ী, পাখি নিধনের সর্বোচ্চ শাস্তি এক লাখ টাকা জরিমানা, এক বছরের কারাদন্ড বা উভয় দন্ড। একই অপরাধ আবার করলে শাস্তি ও জরিমানা দিগুণ। একইভাবে কোনো ব্যক্তি যদি পরিযায়ী পাখির মাংস, দেহের অংশ সংগ্রহ করেন, দখলে রাখেন কিংবা ক্রয়-বিক্রয় করেন বা পরিবহন করেন, সেক্ষেত্রে তার সর্বোচ্চ ছয় মাসের কারাদন্ড এবং সর্বোচ্চ ৩০ হাজার টাকা অর্থদন্ড অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত হওয়ার আইন প্রচলিত রয়েছে। অতিথি পাখি নিধন এবং বাজারে বিক্রি নিষিদ্ধ জেনেও আইনের ফাঁক গলিয়ে এক শ্রেনীর পেশাদার এবং সৌখিন শিকারি কাজগুলো করে চলেছে। এক্ষেত্রে প্রচলিত আইনকে প্রয়োগ করতে হবে কার্যকারভাবে। তৎপরতা বাড়াতে হবে সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রশাসনকে। পাশাপাশি হাওর এলাকার মানুষের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থান দরকার।

বিশাল এই সৃষ্টি জগতে মানুষকে বলা হয়, আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা জীব। সৃষ্টিজগতের সবকিছুই মানুষের সেবায় নিয়োজিত। তাই মানুষ হিসেবে আমাদের রয়েছে কিছু দায়-দায়িত্ব। রাসুল (সঃ) বলেছেন, ‘পৃথিবীতে যারা আছে তাদের প্রতি তোমরা দয়া করো, তাহলে যিনি আসমানে আছেন তিনিও তোমাদের প্রতি দয়া করবেন।’ পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা ৫টি প্রাণীর নামে সুরার নামকরণ করেছেন। আবার ’আনআম’ পশুসম্পদ নামে স্বতন্ত্র একটি সুরা নাজিল করেছেন। এসব কিছুই পশু-পখির প্রতি ভালোবাসার নিদর্শন। পশু-পাখির প্রতি ভালোবাসা ইসলামের অন্যতম শিক্ষা। পৃথিবীতে অসংখ্য প্রজাতির পশু-পাখি রয়েছে। জলে-স্থলে কিংবা উভচরে তারা বসবাস করে। এগুলোর সবই পরিবেশ বান্ধব। পরিবেশের ভারসাম্য রাখতে এসব পশু-পাখির বিকল্প নেই। তাদের যতœ নেয়া আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের মাধ্যম বা অনুগ্রহপ্রাপ্তির সোপান। সুতরাং আমরা কখনো নিজেদের আনন্দেও জন্য তাদের কষ্ট দেবো না। অনেকেই খাঁচায় বিভিন্ন প্রকারের পাখি পালন করেন। এটা জায়েজ আছে। কিন্তু শর্ত হলো, তাদের যথাযথ পরিচর্যা করতে হবে, কোনো ধরনের কষ্ট দেয়া যাবে না।

প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখার জন্যও পাখিদের বাঁচিয়ে রাখার প্রয়োজন আছে। পাখি হলো প্রকৃতির কীটনাশক। পাখির সংখ্যা কমে গেলে কীটপতঙ্গের অত্যাচারে অসম্ভব হয়ে পড়বে ফসল ফলানো। সেটিই যদি হয়, তাহলে নির্ভর করতেই হবে কীটনাশকের ওপর। কিন্তু এটি তো পরিবেশের জন্য খুবই ক্ষতিকর। যে দেশে পাখি বেশি, সে দেখে পর্যটকের সংখ্যাও বেশি। কাজেই পাখি ঘাটতি অবশ্যই উদ্বেগের ব্যাপার। পাখি নিসর্গকে সুন্দর করে, চোখকে প্রশান্তি দেয়, সৌন্দর্য চেতনাকে আলোড়িত করে। পাখিরা আসুক, ওদের কলকাকলিতে ভরে উঠুক আমাদের চারপাশ। আর আমরা অতিথি পাখিদের শিকার না করে, পাখিদের উৎপাত না করার মাধ্যমে তাদের প্রতি সদয় হয়ে বাড়িয়ে দেই আমাদের মানবিক আচরণ।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *