বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪, ০৩:৪১ পূর্বাহ্ন
ডেস্ক রিপোর্ট:
রাজধানীর সন্নিকটে টঙ্গীর কহর দরিয়া খ্যাত তুরাগ নদের অস্তিত্ব এখন চরম হুমকির মুখে। নিয়মিত দখল আর দূষণে হারিয়ে যেতে বসেছে এই নদ। তুরাগ নদের সৌন্দর্য উপভোগ করতে এক সময় বহু মানুষের আনাগোনা ছিল। কিন্তু তুরাগের বর্তমান অবস্থা দেখে দর্শনার্থীদের মন হাহাকার করে ওঠে। এক দশক আগেও যে তুরাগ তারা দেখেছেন, সে তুরাগ এখন আর নেই বললেই চলে।
দূষণ আর দখলের শিকার হয়ে তুরাগ আজ মৃতপ্রায়। এক সময় নদের পানি শোধন করে নগরবাসীর পানির চাহিদা মেটানো হতো। এখন তা একেবারেই পাল্টে গেছে। পানি এতটাই দূষিত যে, তা শোধনেরও উপযোগী নয়। কোথাও কোথাও খালের রূপ নিয়েছে তুরাগ। নদীর জায়গা ভরাট করে নির্মাণ করা হয়েছে নানা ধরনের স্থাপনা। এর দুই তীর জবরদখল করে স্থানীয় প্রভাবশালীরা প্রায় বিনা বাধায় বহুতল ভবন উঠিয়েছেন।
তুরাগ নদের যেটুকু অংশ এখনো খালি আছে তা কী করে হাতিয়ে নিয়ে বস্তি বসানো বা ভবন ওঠানো যায় তা নিয়ে চলে নানা রকমের চক্রান্ত। তুরাগের বুকে সামান্য যে পানিপ্রবাহ আছে তাও কালো কুচকুচে এবং দুর্গন্ধময়। প্রতিদিন ফেলা হচ্ছে আশপাশের বাড়িঘর থেকে ময়লা-আবর্জনা।
এমনকি অনেক কলকারখানার বিষাক্ত বর্জ্যও ফেলা হয় তুরাগের বুকে। ফলে যে মানসিক প্রশান্তির জন্য রোজ মানুষ বেড়াতে আসেন তুরাগের তীরে সেটা আর খুঁজে পাওয়া যায় না। জবরদখলের ফলে এককালের প্রবাহমান তুরাগ এখন শীর্ণ জলাধার। এরপরও প্রতিদিন চলছে তুরাগের পাড়ে মাটিভরাট করে দখলদারদের মহোৎসব।
সরেজমিনে দেখা যায়, শিল্পনগরী টঙ্গীর বিসিক এলাকার কলকারখানার রং মিশ্রিত বিষাক্ত পানি ও নদীর দুই পাড়ের বসতীদের ময়লা আবর্জনা সরাসরি এসে পড়ছে তুরাগ নদিতে। যার কারণে নদীর দুই পাড় ময়লা আবর্জনার ভাগাড়ে পরিনত হয়ে দূর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে আশপাশের এলাকাজুড়ে।
নদীর বুকে ভাসতে দেখা যায় প্লাষ্টিক, পলিথিন, ময়লা কাপড়, বাজারের গরু-মুরগীর আবর্জনা, কাচা তরকারীর ময়লাসহ নানান আবর্জনা। আবর্জনা ফেলতে ফেলতে তুরাগ নদীর দুই পাড়ের বিভিন্ন স্থান এখন ডাষ্টবিনে পরিনত হয়েছে।
নদীর দুই পাড় দখলমুক্ত রাখতে এবং পথচারীদের চলাচলের সুবিধার্থে বর্তমান সরকার ২০১৫ সালে ২১ কোটি টাকা ব্যয়ে ওয়াকওয়ে নির্মাণ করেছে। এতে করে কিছু দিনের জন্য নদীর সৌন্দর্য ফুটে উঠলেও বর্তমানে টঙ্গী বাজারের ব্যবসায়ীরা ওয়াকওয়ে দখল করে দোকান বসিয়ে কয়েক লাখ টাকা ভাড়া আদায় করছে। এতে করে পথচারীদের চলাচলের ওয়াকওয়ে দিয়ে সাধারণ মানুষ চলাচলে চরম বিঘ্ন ঘটছে।
এছাড়া উচ্চ আদালতের নির্দেশে বেশ কয়েকবার তুরাগ নদের তীরে নির্মিত অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান পরিচালিত হলেও কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় আসল চেহারা ফিরে পায়নি নদটি।
বিআইডব্লিউটিএ ও স্থানীয় প্রশাসনের অভিযানে কিছু অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করলেও কর্তৃপক্ষের এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তার সঙ্গে যোগসাজশে সংশ্লিষ্টরা আবার নদীর জমি দখল করে তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছেন। জনসাধারণের ব্যবহৃত বর্জ্য ও কারখানার বিষাক্ত পানি নদের রূপ পাল্টে দিয়েছে।
এদিকে টঙ্গীর ইজতেমা মাঠসংলগ্ন এলাকার অনেক স্থানে নদে খুঁটি বসানো হয়েছে। কিন্তু নদ দখল করতে অধিকাংশ এলাকার পিলার তুলে ফেলেছে স্থানীয় একটি চক্র। আদালতের রায় তালিম করার জন্য তড়িঘড়ি করে কোনো রকমে খুঁটিগুলো পোঁতা হলেও কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় সেগুলোও অযত্নে, অবহেলায় বিপর্যস্ত। পিলারগুলো আংশিক বা পুরোপুরি ভাঙা, কিছু কিছু নিশ্চিহ্ন।
হাইকোর্ট ২০০৯ সালের ২৫ জুন সিএস (ক্যাডাস্ট্রাল সার্ভে) পদ্ধতি অনুসারে আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বর মাসে (বর্ষাকাল) নদের ঢাল থেকে ১৫০ ফুট দূরে সীমানা খুঁটি বসানোর নির্দেশ দিয়েছেন। সীমানা নির্ধারণের ক্ষেত্রে তা মানা হয়নি। ফলে নদের বিপুল পরিমাণ জায়গা বেদখল হয়ে গেছে।
এ বিষয়ে নদী বাঁচাও আন্দোলনের গাজীপুর জেলা শাখার সভাপতি একেএম সিরাজুল ইসলাম জানান, আমরা টঙ্গী থেকে ৭১ কিলোমিটার পর্যন্ত নদী রক্ষার্থে মানববন্ধন করেছি।
ইটিপি বিহীন কলকারখানার বিরুদ্ধে পরিবেশ অধিদপ্তর বরাবর কয়েকদফা লিখিত অভিযোগ করেছি। তাতেও নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না নদের দূষণ। আমরা আন্দোলন করার পর পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃপক্ষ কয়েকদিন দু’একটি কলকারখানাকে জরিমানা করার পর আর খবর নেয়নি।
তুরাগ নদের টঙ্গী অংশে ঐতিহ্যবাহী সিরাজ উদ্দিন সরকার বিদ্যানিকেতন অ্যান্ড কলেজে কয়েক হাজার শিক্ষার্থী প্রতিদিন ক্লাস করেন। নদের দুর্গন্ধময় পানিতে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করাটা অনেকটাই কষ্টকর হয়ে দাড়িয়েছে।
এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ মো. ওয়াদুদুর রহমান জানান, আমাদের স্কুলে প্রায় সাড়ে চার হাজার শির্ক্ষাথী রয়েছে। ক্লাস চলাকালিন সময় নদের বিষাক্ত পানির দূর্গন্ধের কারণে স্কুলের দক্ষিণ পাশের জানালা বন্ধ করে পড়ানো হয়। স্থানীয় কলকারখানার বিষাক্ত রংয়ের পানি ও টঙ্গী বাজারের ময়লা আর্বজনা ফেলার কারণে নদের পানি দূষিত হয়ে দূর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। এতে করে কোমলমতি শির্ক্ষাথীরা প্রতিনিয়ত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।