শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ০২:৪৬ অপরাহ্ন

প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু টানেল উদ্বোধন করবেন: দেশের যোগাযোগের ক্ষেত্রে নতুন দিগন্তের সূচনা আজ

বর্তমানকণ্ঠ ডটকম / ১৪৭ পাঠক
শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ০২:৪৬ অপরাহ্ন

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের উদ্বোধন করবেন। এর ফলে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় আজ এক নতুন দিগন্তের সূচনা হতে যাচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রী পতেঙ্গায় কর্ণফুলী নদীর পশ্চিম তীরে একটি এবং টানেল পার হয়ে সকাল ১১টায় আনোয়ারায় নদীর দক্ষিণ তীরে আরেকটি ফলক উন্মোচন করবেন। ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি ৭১ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত প্রায় ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ টানেলটি রোববার সকাল ৬টা থেকে যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হবে।

স্বপ্ন ছোঁয়ার অপেক্ষায় দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী ও বন্দরনগরী চট্টগ্রামে উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করছে। কর্ণফুলী নদীর তীরে কান পাতলেই যেন শোনা যাচ্ছে অপার সম্ভাবনা আর উন্নয়নের জয়ধ্বনি। নদীর তলদেশ দিয়ে তৈরি টানেলে গতি বাড়বে বাণিজ্য, শিল্পায়ন ও উন্নয়নের। দূরত্ব কমাবে চট্টগ্রামের সঙ্গে কক্সবাজারের। কমবে পরিবহন ব্যয়, সাশ্রয় হবে সময়ের।

এতসব সম্ভাবনা নিয়ে জানতে চাইলে সিটি মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, টানেলের মাধ্যমে আলোর মুখ দেখতে যাচ্ছে ১৬৮ কিলোমিটার পৃথিবীর দীর্ঘতম মেরিন ড্রাইভও। কক্সবাজারের মহেশখালীর ৭২টি মেগা প্রকল্পের সঙ্গে চট্টগ্রামের সংযোগও তৈরি করতে যাচ্ছে এই টানেল। পদ্মা সেতুর মতো জাতীয় অর্থনীতিতে এই টানেলও বড় ভূমিকা রাখতে যাচ্ছে।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম বলেন, অর্থনীতি সুদৃঢ় করতে এই টানেল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। শুরুতে টানেলে বেশি গাড়ি চলবে বলে মনে হচ্ছে না। তবে ধীরে ধীরে বাড়বে। টানেলের পূর্ণ সুফল পেতে হলে মিরসরাই থেকে মেরিন ড্রাইভ নিতে হবে কক্সবাজার পর্যন্ত। তখন টানেল ঘিরে নদীর ওপারেও গড়ে উঠবে শিল্পাঞ্চল। গড়ে উঠবে নতুন নতুন শিল্প-কারখানা।

রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক, সাবেক ইউসিজি চেয়ারম্যান এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আবদুল মান্নান বলেন, ‘নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণ শুধু বাংলাদেশে নয়, সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ায় এটি প্রথম। এই মেগা প্রকল্পের জন্য কেবল চট্টগ্রামের বাসিন্দা হিসেবে নয়, সারা বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে আমি গর্বিত।’

যেকোনো দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য অবকাঠামোগত উন্নয়ন অপরিহার্য বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

তিনি আরও বলেন, ‘২০০৮ সালে নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছিলেন, চট্টগ্রামের দায়িত্ব তিনি নিজহাতে তুলে নিয়েছেন। তিনি ধীরে ধীরে একের পর এক প্রকল্প বাস্তবায়ন করে উন্নয়ন কর্মে এগিয়ে নেন চট্টগ্রামকে। আজ টানেল উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে সেই ঘোষণা পূর্ণ বাস্তবায়নের পথে।’

এই টানেল উদ্বোধনের সাথে পণ্য পরিবহণে অনেক সুবিধা পাবে বাণিজ্যিক খাত। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক বিজিএমইএর সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজির ট্রাস্টি বোর্ড চেয়ারম্যান নাসিরুদ্দীন চৌধুরী বলেন, ‘এই টানেল আমাদের জন্য এক বিশাল পাওনা। এই টানেলের মাধ্যমে যে কানেক্টিভিটি তৈরি হবে, তা কেবল চট্টগ্রামে নয়, সারা দেশের জন্য এক যুগান্তসৃষ্টিকারী পদক্ষেপ হিসাবে ইতিহাসের পাতায় লিখিত থাকবে।’

তিনিঁ বলেন, এই টানেলের মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ‘ওয়ান টাউন টু সিটি’ কনসেপ্ট বাস্তবায়িত হচ্ছে। এই টানেল আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখবে। নদীর দুই পারে নতুন নতুন শিল্পাঞ্চল ও অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে উঠবে। তবে টানেলের সুফল সত্যিকার অর্থে পেতে হলে পরিকল্পিত নগরায়ন এবং পরিকল্পিত অর্থনৈতিক জোন পরিচালনায় দক্ষ ও অভিজ্ঞ কর্তৃপক্ষের প্রয়োজন।

দক্ষিণ জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শামীমা হারুন লুবনা বলেন, এই টানেল শুধু একটি সাধারণ পথ নয়, এটি প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবার নিদর্শন। ‘

এ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী চট্টগ্রামে বেশ কয়েকটি প্রকল্পের উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন। প্রধানমন্ত্রী একটি বিশেষ স্মারক ডাকটিকিট, উদ্বোধনী দিনের খাম এবং প্রথম পানির নিচের সড়ক টানেলের উদ্বোধন উপলক্ষে একটি বিশেষ সীলমোহরও প্রকাশ করবেন।

আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা আনোয়ারায় কোরিয়ান ইপিজেড (কেইপিজেড) মাঠে এক জনসভায় ভাষণ দেবেন। এতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীসহ বিপুল সংখ্যক মানুষ উপস্থিত হবেন বলে আশা করা হচ্ছে। জনসভায় ১০ লাখ লোক সমাগমের টার্গেট নিয়েছে আওয়ামী লীগ।

প্রধানমন্ত্রীর জনসভা সফল করতে চলছে ব্যাপক প্রস্তুতি। চট্টগ্রাম নগরের বায়েজিদ-ফৌজদারহাট লিংক রোড, ফৌজদারহাট থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত আউটার রিং রোড এবং টানেলের অপর প্রান্ত আনোয়ারা থেকে শাহ আমানত সেতু এলাকাসহ নগরের বিভিন্ন সড়ক অপরূপ সাজে সাজানো হয়েছে।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই জনসভাকে ঘিরে দলীয় প্রধানের দৃষ্টি কাড়তে তৈরী করা হয়েছে অসংখ্য তোরণ, নগরীজুড়ে টানানো হয়েছে রং-বেরংয়ের ব্যানার-ফেস্টুন।

মাইকে প্রচার করা হচ্ছে আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়নের চিত্র। বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে এলইডি টিভি বসিয়ে দেখানো হচ্ছে উন্নয়নের স্থিরচিত্র। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এম. রেজাউল করিম চৌধুরীর উদ্যোগে নগরজুড়ে পাঁচ শতাধিক বিলবোর্ড, ব্যানার-ফেস্টুন, তোরণ শোভা পাচ্ছে। এছাড়া প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানিয়ে সাবেক মেয়র ও নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন ও শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের অনুসারীরাও পাঁচ হাজারের বেশি ব্যানার-ফেস্টুন টাঙিয়েছেন। এর বাইরে স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরাও প্যানাফ্লেক্স, ব্যানার-ফেস্টুন ও তোরণে প্রধানমন্ত্রীকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।

অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরাও দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন দলটির শীর্ষ নেতাকে বরণ করে নিতে। প্রধানমন্ত্রীর আগমন উপলক্ষে পৃথক বর্ধিত সভা করেছে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলো।

দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান বলেন, ৮ ফুট উচ্চতার মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে। ৩০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৪৮ ফুট প্রস্থের মঞ্চটি নৌকার আদলে তৈরি করা হয়েছে। প্রায় ৫০০ জনের বসার ধারণক্ষমতা থাকলেও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় পদধারী নেতা ও জনপ্রতিনিধি মিলে ৩০০ জনের বসার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ঢাকার কলরেডি থেকে আসা ২০০ মাইক জনসভাস্থলের আশপাশে কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে লাগানো হয়েছে।

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানাতে সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। চট্টগ্রামে সফরকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু টানেলসহ মোট ২০টি প্রকল্পের উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন। এর মধ্যে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের সাতটি প্রকল্প রয়েছে। অনেকগুলোর কাজই প্রায় শেষ হয়েছে। যেগুলো হয়নি সেগুলো আগামী বছরের জুনের মধ্যে সম্পন্ন হয়ে যাবে।

টানেল উদ্বোধন ও জনসভা ঘিরে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা নেওয়া হয়েছে পতেঙ্গা থেকে আনোয়ারায়। স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স (এসএসএফ), পুলিশ, র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা জনসভাস্থলসহ আশপাশের কয়েক কিলোমিটার এলাকা ঘিরে রেখেছে। সিএমপি কমিশনার কৃষ্ণ পদ রায় সার্বিক আইনশৃঙ্খলা কার্যক্রম পরিদর্শন করেছেন।

চট্টগ্রাম উপ পুলিশ কমিশনার আবদুল ওয়ারিশ বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সমাবেশকে কেন্দ্র করে কয়েক স্তরের নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। সাদা পোশাকের গোয়েন্দা তৎপরতাও বাড়ানো হয়েছে। নিরাপত্তায় প্রায় আড়াই হাজার পুলিশ সদস্য মোতায়েন থাকবে। জেলা পুলিশের পাশাপাশি বাইরের জেলা থেকেও এখানে পুলিশ আসবে। ট্রাফিকের জন্যও বিশেষ ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে। সাধারণ মানুষের যেন কোনো ভোগান্তি না হয় সেজন্য ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, নিরাপত্তার প্রশ্নে যেসব বিষয় জড়িত প্রত্যেকটি বিষয়কে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। নিরাপত্তার প্রশ্নে আমরা কোনো ছাড় দেব না। আমরা চাই নিরাপত্তার পাশাপাশি এখানে জনসমাবেশ স্থলে আগত জনগণ যেন উৎসবমুখর পরিবেশ পায়।

আরও ১৯ প্রকল্পঃ টানেল উদ্বোধনের পাশাপাশি আরও ১৯টি প্রকল্পের উদ্বোধন এবং ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওইদিন সকাল ১০টায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল উদ্বোধনের পর ইপিজেড মাঠে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ জনসভায় যোগ দেবেন প্রধানমন্ত্রী।

জেলা প্রশাসন থেকে জানা যায়, এবারের সফরে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু টানেল ছাড়া চট্টগ্রাম মুসলিম ইনস্টিটিউট সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স, জেলা পরিষদ টাওয়ার, রাঙ্গুনিয়া ও আনোয়ারা জেলা পরিষদ ডাকবাংলো, পটিয়ায় শেখ কামাল অডিটোরিয়াম কাম মাল্টিপারপাস হল, রাউজানে শেখ কামাল কমপ্লেক্স, আগ্রাবাদে সিজিএস কলোনিতে ৯টি বহুতল আবাসিক ভবন, বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধু ম্যুরাল, শিকলবাহা খালের ওপর পিসি গার্ডার ব্রিজ, ডিসি পার্ক, হাজার বছরের নৌকা জাদুঘর, ১৯১টি ইউনিয়নে খেলার মাঠ ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, স্মার্ট স্কুল বাস সার্ভিস ও পর্যটক বাস, রিভার ক্রুজ ও ফুল ডে ট্যুর সম্বলিত পর্যটন সেবা, বার্ডস পার্ক ও চিড়িয়াখানার আধুনিকীকরণ প্রকল্পের ফলক উন্মোচন করবেন।

এ ছাড়া ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ ও জাদুঘর নির্মাণ, বিমানবন্দর থেকে বঙ্গবন্ধু টানেল পর্যন্ত শেখ হাসিনা সড়ক এবং সিমেন্স হোস্টেল কমপ্লেক্স ভবন নির্মান প্রকল্পের।

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আবুল বাশার মো. ফখরুজ্জামান জানান, প্রকল্পগুলোর অনেকগুলোর কাজই প্রায় শেষ। যেগুলো হয়নি, সেগুলো আগামী বছরের জুনের মধ্যে শেষ হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ১৪ অক্টোবর, ২০১৭ তারিখে কর্ণফুলী টানেলের নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন। ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি শেখ হাসিনা টানেল বোরিং ফেজও উদ্বোধন করেন।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *