রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ০২:৪৭ পূর্বাহ্ন

মোনালিসা-আঁকিয়ের ছবি বিক্রির রহস্য জানুন

বর্তমানকণ্ঠ ডটকম / ৩৫ পাঠক
রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ০২:৪৭ পূর্বাহ্ন

নিউজ ডেস্ক,বর্তমানকণ্ঠ ডটকম,মঙ্গলবার, ২১ নভেম্বর ২০১৭: গোপনে রোমান চার্চের আধিপত্য অগ্রাহ্য করতেন কি প্রায়োরি অফ সিওন-এর মস্তিষ্ক লিওনার্দো? নাকি তিনি বিশ্বাস করতেন না, জিশু ক্রুসবিদ্ধ অবস্থাতেই প্রয়াত হন? ১৫ নভেম্বর, ২০১৭ শিল্পজগতের ইতিহাসে একটা দিকচিহ্ন হয়ে থাকবে। এই দিন নিউইয়র্কের নিলামঘর ‘ক্রিস্টি’জ’-এ ইতালীয় রেনেসাঁসের প্রাণপুরুষ লিওনার্দো দা ভিঞ্চির প্রখ্যাত পেন্টিং ‘সালভাতোর মুন্ডি’ বিক্রি হল ৪৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যে। এই ছবিটিই এখনও পর্যন্ত বিক্রিত পেন্টিংগুলির মধ্যে মহার্ঘ্যতম। এটি একটি বিশ্ব রেকর্ড। মোনালিসা-স্রষ্টার হাতে আঁকা কোনও ছবি যে মহামূল্যবান, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ থাকতে পারে না। কিন্তু ‘সালভাতোর মুন্ডি’-র এই বিপুল দাম স্তব্ধ করে দিয়েছে শিল্পরসিকদের। বিশ্বময় শুধু একটাই জল্পনা— ঠিক কী কারণে এই দাম? কেন এই ছবিটিই বিশ্বের মহার্ঘ্যতম পেন্টিং হিসেবে বিবেচিত হল?

এই ছবির ইতিহাস সম্পর্কে যা জানা যাচ্ছে, তাতে কাহিনি-কিংবদন্তির মিশেল যথেষ্ট। অনুমান করা হয়, ফরাসি রাজ দ্বাদশ লুই ভিঞ্চিকে এই ছবিটির বরাত দিয়েছিলেন এবং পরে এই ছবি শোভা পেয়েছিল ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম চার্লসের কক্ষে। ১৮ শতকে ছবিটি হারিয়ে যায়। আবার বিংশ শতকে এটির হদিশ পাওয়া সম্ভব হয়। ক্রিস্টি’জ-এর নিলামে ছবিটি বিক্রি করেন রুশ ব্যবসায়ী ডিমিট্রি রিবোলোভ্লেভ। কিন্তু ছবিটি কে কিনেছেন, সেটি জানা যায়নি।

২০ মিনিটের হাড্ডাহাড্ডি দর কষাকষির পরে ৪৫.৪ x৬৫.৬ সেন্টিমিটার মাপের ছবিটি বিক্রি হয়। ওয়ালনাট প্লাকের উপরে তেলরংয়ে আঁকা এই ছবিটি জিশু খ্রিস্টের একটি বিশেষ রূপের। ‘সালভাতোর মুন্ডি’ শব্দবন্ধটির অর্থ— ‘বিশ্বের ত্রাণকর্তা’। জিশুর হাতের একটি বিশেষ ভঙ্গি এই রূপটির বিশেষত্ব। অন্য হাতে জিশু এখানে একটি গোলক ধরে থাকেন, যা বিশ্বের প্রতীক। রূপটির মরমি তাৎপর্য বিপুল।

ফ্লোরেন্সে ভিঞ্চির মূর্তি, ভাস্কর: লুইগি পাম্পালোনি,

বেশ কিছু শিল্প-ইতিহাসবিদ ওজর তুলেছেন, ‘সালভাতোর মুন্ডি’ ছবিটি লিওনার্দোর একটি তুলনামূলক নিরেস চিত্রকর্ম। ‘মোনালিসা’ বা ‘ভার্জিন অন দ্য রকস’-এর তুলনায় এটি নাকি কিস্যু না। আনুমানিক ১৫০০ খ্রিস্টাব্দে আঁকা এই ছবিটি তেমন ভাবে আলোচিতও নয় লিওনার্দোর জীবনীকারদের মধ্যে। এটিকে ভিঞ্চির ‘আরও একটি ছবি’ হিসেবেই পেশ করা হয়েছে। কিন্তু এই মুহূর্তে এই ছবি বিশ্বের সব থেকে দামি শিল্পকর্ম। প্রশ্ন উঠতেই পারে, কেন এই দাম?

শিল্প সাংবাদিক টিম শ্নেইডার ‘আর্টনেট নিউজ’ নামক ওয়েবসাইটে প্রশ্ন তুলেছেন ‘সালভাতোর মুন্ডি’-র এই ‘হাইপ’ নিয়ে। তাঁর রচনা টেকনিক্যাল। নিলাম, শিল্পবস্তুকে ঘিরে সম্ভাব্য ক্রেতাদের মনস্তাত্ত্বিক জোয়ার-ভাটা ইত্যাদি তিনি তুলে ধরেছেন। এবং শেষমেশ এটা উল্লেখ করেছেন যে, ছবির ট্যাগ-এ লিওনার্দো দা ভিঞ্চি নামটি সেঁটে থাকাতেই এই দাম।

ইতালীয় রেনেসাঁসের অন্য শিল্পীরা কি এই বিপুল ভাবতরঙ্গ আজ আর সৃষ্টি করতে পারেন? এর উত্তরে বলা যায়, ভিঞ্চিকে ঘিরে যে কাহিনি-কিংবদন্তি-রোমাঞ্চ পল্লবিত হয়ে রয়েছে, তার কণামাত্র মাইকেলেঞ্জেলো বা তিশানকে নিয়ে নেই। চিত্রকর, স্থপতি, ভাস্কর, বৈজ্ঞানিক, প্রযুক্তিবিদ, সাহিত্যিক, শারীরবিদ্যা বিশারদ, জ্যোতির্বিদ, উদ্ভিদবিজ্ঞানী, ঐতিহাসিক এবং মানচিত্রকর এই ব্যক্তিটি সত্যিই বিরাট গোলমেলে।

২০০৩ সালে মার্কিন থ্রিলার লেখক ড্যান ব্রাউন তাঁর ‘দ্য দা ভিঞ্চি কোড’ উপন্যাসে ভিঞ্চিকে এমন এক রংয়ে পেন্ট করেন, যাতে এই রহস্যময় মানুষটিকে ঘিরে আরও বেশি রহস্য ঘনিয়ে ওঠে। ব্রাউন ভিঞ্চিকে খ্রিস্টীয় জগতের সবথেকে গোপন এক গোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে বর্ণনা করেন। ‘প্রায়োরি অফ সিয়ন’ নামের এই গুপ্ত সমিতির হাতেই নাকি রয়েছে বিশ্বের প্রধানতম রহস্যের চাবি। এই কোডকে ভাঙতে পারলেই চিররহস্য হাতের মুঠোয়। ব্রাউন গল্পটি আকাশ থেকে নামাননি। ভিঞ্চির সঙ্গে প্রায়োরি-র যোগের কথা প্রথম বলেছিলেন মাইকেল বেইগান্ট, রিচার্ড লি ও হেনরি নিকোলাস তাঁদের ঝড় তোলা গবেষণাগ্রন্থ ‘হোলি ব্লাড হোলি গ্রেল’ (১৯৮২)-এ। ব্রাউন এই বই থেকে প্রভূত তথ্য তাঁর উপন্যাসে ব্যবহার করেছিলেন।

‘সালভাতোর মুন্ডি’ রেনেসাঁস শিল্পীদের একটি অতি প্রিয় বিষয়। ভিঞ্চি ছাড়াও জান ভ্যান আইক, আলব্রেখট ড্যুরার, তিশান প্রমুখ যুগন্ধর জিশুর এই বিশেষ রূপটি এঁকেছেন। এই বিশেষ রূপটির কিছু মরমি তাৎপর্য রয়েছে, একথা আগেই বলা হয়েছে। যদি ভিঞ্চি সত্যিই কোনও গোপন খ্রিস্টীয় তত্ত্বের ধারক হয়ে থাকেন এবং তাঁর প্রতিটি শিল্পকর্ম যদি এই তত্ত্বকে ব্যক্ত করার সংকেত হয়ে থাকে, তা হলে ‘সালভাতোর মুন্ডি’-ও তার ব্যতিক্রম নয়। দেখা যেতে পারে কয়েকটি বিষয়কে।

সালভাতোর মুন্ডি: প্রথমটি ভিঞ্চির ও পরেরটি তিশানের আঁকা।

• তিশান বা অন্যান্য শিল্পীদের আঁকা ‘সালভাতোর মুন্ডি’-র হাতে একটি বিশেষ গ্লোব থাকে। এই গ্লোবটি ‘গ্লোবাস ক্রুসিগার’ নামে পরিচিত। এই গ্লোবের উপরে একটি ক্রস অবধারিত ভাবে অবস্থান করে। এই ক্রসটি রাজকীয়তার প্রতীক। খ্রিস্টকে রাজা হিসেবে দেখানোর দ্যোতক। লিওনার্দোর ছবিতে গ্লোব অবশ্যই রয়েছে, কিন্তু ক্রস নেই। কেন? গোপনে রোমান চার্চের আধিপত্য অগ্রাহ্য করতেন কি প্রায়োরি অফ সিওন-এর মস্তিষ্ক লিওনার্দো? নাকি তিনি বিশ্বাস করতেন না, জিশু ক্রুসবিদ্ধ অবস্থাতেই প্রয়াত হন?

• লিওনার্দোর ‘সালভাতোর মুন্ডি’-র হাতে ধরা গ্লোবটি স্ফটিকের। স্ফটিক গোলক ইউরোপে ভবিষ্যৎ কথনের কাজে ব্যবহৃত হতো। জিশুকে কি ভবিষ্যদ্রষ্টা হিসিবে দেখাতে চেয়েছিলেন লিওনার্দো?

• ভিঞ্চির ‘সালভাতোর মুন্ডি’-তে জিশু শ্মশ্রুগুম্ফহীন। এমন চেহারার জিশু খুব কমই আঁকা হয়েছে। ১৫০০ খ্রিস্টাব্দে ভিঞ্চি এই ছবি আঁকেন। এর ১০১ বছর পরে বারোক শৈলির প্রধানতম শিল্পী ক্যারাভাজ্জিও ‘সাপার অ্যাট এমাউস’ নামে এক ছবিতে জিশুকে শ্মশ্রুগুম্ফহীন দেখান। ‘বাইবেল’-এর ‘মার্ক কথিত সুসমাচার’-এ পুনরুত্থানের পরে জিশু তাঁর শিষ্যদের সঙ্গে এমাউস নামে একটি স্থানে এক সরাইখানায় দেখা করেন। তিনি তখন ‘ভিন্ন চেহারা’-য় ছিলেন। তাই তাঁর শিষ্যরা তাঁকে প্রথমে চিনতে পারেননি। ক্যারাভাজ্জিও এই ‘ভিন্ন চেহারা’টি তৈরি রেন জিশুকে শ্মশ্রুগুম্ফহীন দেখিয়ে। এই ছবির শতবর্ষ আগে কেন লিওনার্দো এই চেহারাটি এঁকেছিলেন?

সাপার অ্যাট এমাউস (১৬০১), শিল্পী: ক্যারাভাজ্জিও,

• ‘সালভাতোর মুন্ডি’-তে জিশুর ডান হাতটি এক বিশেষ ভঙ্গিমায় থাকে। এতে দু’টি আঙুল উত্থিত দেখা যায়। বাকি সায়েস্ত্রেদের আঁকা ‘সালভাতোর মুন্ডি’-তে জিশুর তর্জনি ও মধ্যমা একযোগে উত্থিত থাকে। লিওনার্দোর ছবি একটি ব্যতিক্রম। এতে মধ্যমা ঈষৎ বাঁকানো, খানিকটা নীচের দিকে নামানো। আর তর্জনি উর্ধ্বে উত্থিত। লিওনার্দো নিজে অ্যাগনস্টিক দর্শনে বিশ্বাসী ছিলেন। এই প্রাচীন গ্রিক দর্শন পরে রোমান চার্চের দাপটে গুপ্ত সমিতিগুলির চর্চার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। প্রায়োরি অফ সিওন এই দর্শনকে গোপনে বহন করতে শুরু করে। এই দর্শনের অন্যতম বক্তব্য— প্রত্যক্ষ জ্ঞান বা চিরসত্যের সন্ধান লাভ সম্ভব। এই জ্ঞান কোনও এজেন্সি বা প্রতিষ্ঠান মারফত পাওয়া সম্ভব নয়। অন্য ভাবে দেখলে অ্যাগনস্টিকরা ঈশ্বর ও মানুষের মধ্যবর্তী হিসেবে চার্চের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করেন। জিশু তাঁদের কাছে প্রত্যক্ষ জ্ঞানের ধারক। এই জ্ঞানকে একটি মাত্র বাক্যে প্রকাশ করা হয়। সেটি হল— ‘অ্যাজ অ্যাবাভ সো বিলো’। অর্থাৎ, যা এই মানবদেহে বর্তমান, তা-ই মহাবিশ্বের সারবস্তু। আরাও খোলসা করে বললে, আত্মজ্ঞান লাভ হলেই বিশ্বজ্ঞান লাভ হয়। লিওনার্দোর ‘সালভাতোর মুন্ডি’-র উত্থিত তর্জনি কি ‘অ্যাজ অ্যাবাভ’ আর ঈষৎ নত মধ্যমা কি ‘সো বিলো’-কে বোঝাতে চাইছে?

সব মিলিয়ে এই ছবি দারুণ রহস্যময়। যে অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি এই ছবিকে ৪৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে কিনলেন, তিনি নিছক শিল্পবস্তু হিসেবে এটিকে সম্ভবত কেনেননি। ভিঞ্চি, তাঁর কোড, সেই কোডের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা চিররহস্যের ইঙ্গিত আর সেই সঙ্গে পাঁচ শতকের ইতিহাস এই ছবির সঙ্গে জড়িত। সেদিক থেকে দেখলে ৪৫০ মিলিয়ন ডলারকে সস্তাই বলা যায়।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *