শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ০২:২৯ অপরাহ্ন

যে গ্রামে গরু জবাই হয় না, এমনকি কোরবানির ঈদেও

বর্তমানকণ্ঠ ডটকম / ৬৯ পাঠক
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ০২:২৯ অপরাহ্ন

যশোর সদর উপজেলার কচুয়া ইউনিয়নের ভগবতিতলা গ্রামে একটি খামারে কয়েকটি গরুযশোর সদর উপজেলার কচুয়া ইউনিয়নের ভগবতিতলা গ্রামে একটি খামারে কয়েকটি

আর এক দিন পেরোলেই ঈদুল আজহা। ত্যাগের মহিমায় উজ্জীবিত হয়ে মুসলমানেরা পশু কোরবানির প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কিন্তু যশোর সদর উপজেলার কচুয়া ইউনিয়নের ভগবতীতলা গ্রামে অনেক বছর ধরে হয় না গরু জবাই। গ্রামবাসীর বিশ্বাস, গরু জবাই বা এর দুধ বিক্রি করলে তাঁদের ক্ষতি হয়। এমনকি মৃত্যুর মতো ঘটনাও ঘটে বলে দাবি করছেন তাঁরা।

কোরবানির সময় পার্শ্ববর্তী গ্রাম থেকে গরু জবাই করে মাংস প্রস্তুত করে আনেন বলে জানান ভগবতীতলা গ্রামের লোকজন। তবে সচেতন মহল বলছে, বিষয়টি কুসংস্কারমূলক। এমনটি না মেনে চলাই ভালো।

ভগবতীতলা গ্রামের লোকজন জানান, ১৮৪৬ সালের দিকে গ্রামে গুটি বসন্তের প্রাদুর্ভাবে অনেক মানুষ মারা যায়। ওই সময় গ্রামে আসেন এক ফকির। তিনি গ্রামের একটি বাড়িতে গিয়ে জানান, তাঁর গরুর দুধের প্রয়োজন। আশপাশের অনেক গ্রামে যান কিন্তু কোথাও দুধ পাননি। তখন তাঁকে এই গ্রাম থেকে চাহিদামতো বিনা মূল্যে দুধ দেওয়া হয়।

ওই দুধ নিয়ে ফকির গ্রামের তিন রাস্তার মোড়ে পায়েস রান্না করে গ্রামবাসীকে খাওয়ান। ওই সময় তিনি বলেন, ‘যেহেতু এই গ্রামে দুধ পাওয়া গেছে, তাই এই গ্রাম ভাগ্যবতী।’ যাওয়ার সময় ওই ফকির নির্দেশ দেন, ‘এই গ্রামের কেউ যেন গরু জবাই ও দুধ বিক্রি না করে। এটা মেনে না চললে ক্ষতি হবে।’ সেই থেকে এই রীতি পালন করে আসছেন গ্রামটির বাসিন্দারা।

গরু জবাই না হওয়ার বিষয়ে ভগবতীতলা গ্রামের প্রবীণ বাসিন্দা লিয়াকত আলী শোনালেন আরেক কথা। তিনি বলেন, ‘অনেক বছর আগে এক ব্যক্তি আশপাশের গ্রামে গরুর দুধের সন্ধান করেছিলেন। কিন্তু কোথাও না পেয়ে আমাদের গ্রামে আসেন। এখানে এসে দুধ পেয়েছিলেন। তখন আমাদের গ্রামের নাম ছিল রুপাই মানিক গ্রাম। দুধ পাওয়ার পর ওই ব্যক্তি গ্রামের নাম বদলে রাখেন ভাগ্যবতীতলা। আর ঘোষণা দেন এই গ্রামের মানুষ দুধ বিক্রি করতে পারবেন না। তবে কেউ চাইলে দেওয়া যাবে। গরু জবাইও করা যাবে না।’

অজ্ঞাত ব্যক্তির নিষেধাজ্ঞার পর থেকে ভগবতীতলা গ্রামে গরু জবাই না হওয়ার কথা জানান লিয়াকত আলী। তিনি বলেন, ‘গ্রামে একজন বাক্‌প্রতিবন্ধী নারী ছিলেন। তিনি একবার গরুর ঘি বিক্রি করেছিলেন। এ জন্য গায়ে ঘা হয়ে তাঁর মৃত্যু হয়।’

লিয়াকত আলী আরও দাবি করেন, “একবার মৌলভি মোহাম্মদ নামের এক ব্যক্তি ঘোষণা দেন ‘আগের যুগ নেই, আসেন গরু জবাই করি। কিছুই হবে না।’ তিনি গরু জবাই করেছিলেন। পরে তিনি রোগে ভুগে মারা যান।”

পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়সী নাছিমা বেগম বলেন, ‘শাশুড়ির কাছ থেকে শুনেছি, গরু জবাই ও দুধ বিক্রি করা যাবে না। এই নির্দেশ আমরাও মেনে চলছি। গাভির চেয়ে ষাঁড় বেশি পালন করি।’ তিনি আরও বলেন, “বছর বিশেক আগে গ্রামের মাঠে প্রশিক্ষণের কাজে আর্মি (সেনাবাহিনী) এসেছিল। গ্রামের ঘটনা শুনে এক মেজর বলেছিলেন ‘আমরা গরু জবাই করে খাব। কিচ্ছু হবে না।’ তিনি আমাদের গ্রাম থেকে একটি গরু কিনে জবাই করেছিলেন। পরে শুনেছি, ওই মেজর প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।’

গরু জবাই ও দুধ বিক্রি নিষিদ্ধ হলেও খাওয়া বন্ধ নেই বলে জানান গ্রামের কয়েকজন বাসিন্দা। তাঁরা বলেন, ‘কোরবানির সময় গ্রামের মৌজার বাইরে গিয়ে গরু জবাই করে মাংস প্রস্তুত করে বাড়িতে এনে কোরবানির আনুষ্ঠানিকতা শেষ করি।’

এ বিষয়ে স্থানীয় কচুয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান লুৎফর রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বংশপরম্পরায় দীর্ঘদিন ধরে এই রীতি চলে আসছে। কোরবানির ঈদেও অন্য গ্রাম থেকে গরু জবাই করে আনা হয়। বিভিন্ন সময়ে তাঁদেরকে কুসংস্কার ভাঙতে বলা হয়েছে। তবে তাঁরা শোনেন না। পূর্বপুরুষের রেওয়াজ হিসেবে গ্রামের মানুষ এটা মানছেন। আমি এলাকার জনপ্রতিনিধি, এ নিয়ে জোর করলে আমার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যাবে গ্রামবাসী।’

ভগবতীতলা গ্রামবাসীর গরু জবাই না করার বিষয়টিকে বিজ্ঞানসম্মত নয় বলে জানান যশোর সরকারি এম এম কলেজের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হামিদুল হক শাহীন। তিনি বলেন, গ্রামের শিক্ষকসহ সচেতন ব্যক্তিদের কুসংস্কার ভেঙে বের হয়ে আসতে হবে। গ্রামবাসীকে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে চলার পরামর্শ দেন তিনি।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *