শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ০৭:২৩ অপরাহ্ন

শঙ্কায় হাত হারানো রাজীব

বর্তমানকণ্ঠ ডটকম / ৭৪ পাঠক
শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ০৭:২৩ অপরাহ্ন

নিউজ ডেস্ক,বর্তমানকণ্ঠ ডটকম,শুক্রবার,০৬ এপ্রিল ২০১৮:
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে (আইসিইউতে) বিছানায় শুয়ে ভাবলেশহীন শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকছেন রাজীব হোসেন। কারও তেমন একটা ডাকে সাড়া দিচ্ছেন না। মুখে তুলছেন না খাবার। সিটি স্ক্যান ও এমআরই করার পর গত বৃহস্পতিবার চিকিৎসকরা জানান, তার মস্তিষ্কে আঘাত লেগেছে। সেখানে রক্ত জমে আছে। মাথার খুলিতেও চিড় ধরেছে। তার অবস্থা এখনো আশঙ্কামুক্ত নয়।
রাজীবের খালা খাদিজা বেগম লিপি গতকাল শুক্রবার জানিয়েছেন, রাজীব এখনো বুঝতে পারছে না যে, ওর একটা হাত নেই। এমনকি সে এটাও বুঝতে পারছে না যে, ও হাসপাতালে আছে নাকি বাসায় আছে। তিনি জানান, দুর্ঘটনার পর থেকে সে একটা ঘোরের মধ্যে আছে। অনেকে আসছে দেখা করার জন্য, তাকে ডাকছে, কিন্তু সাড়া দিচ্ছে না। সাড়া দিলেও সেটা স্বাভাবিক নয়।
গত ৩ এপ্রিল রাজধানীতে বিআরটিসি ও স্বজন পরিবহনের দুই বাসের রেষারেষিতে একটি হাত হারিয়েছেন রাজীব। দুই বাসের চাপায় ডান হাতটি কনুইয়ের উপর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। দুই বাসের মাঝখানে ঝুলতে থাকা রাজীবের হাতের ছবি নাড়িয়ে দিয়েছে গোটা দেশের বিবেক। রাজীবের পরিবারসূত্রে জানা গেছে, পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার বাঁশবাড়ি গ্রামের রাজীব তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় মা এবং অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় বাবাকে হারান। ঢাকার মতিঝিলে খালার বাসায় থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পাস করে তিনি ভর্তি হন তিতুমীর কলেজে। খাদিজা বেগম জানান, তিতুমীর কলেজে স্নাতকে ভর্তি হওয়ার পর রাজীব যাত্রাবাড়ীর একটি মেসে থেকে পড়াশোনার পাশাপাশি কম্পিউটারের দোকানে কম্পোজের কাজ করে নিজের পড়াশোনা আর ছোট দুই ভাইয়ের খরচ চালাতেন।
বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে রাজীবের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে খালা খাদিজা বলেন, ওকে যখন রাজীব বলে ডাক দেই, ও শুধু ‘হ্যাঁ’ বলে, আর কোনো কথা বলে না।
ইতোমধ্যে রাজীবের চিকিৎসার ভার নিয়েছে সরকার। গত বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম রাজীবকে দেখতে যান। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, রাজীব সুস্থ হলে তার সরকারি একটি চাকরির ব্যবস্থা করা হবে। সম্ভব হলে তার হাত প্রতিস্থাপন করা যায় কি না- সে চেষ্টাও করা হবে। তবে রাজীব আদৌ সুস্থ হয়ে ফিরবে কি না- এ নিয়ে শঙ্কা বিরাজ করছে রাজীবের পরিবারের সদস্যদের মধ্যে। প্রথমে ধারণা করা হয়েছিল, শুধু হাতই কাটা পড়েছে। কিন্তু পরবর্তীতে অন্যান্য পরীক্ষা-নিরীক্ষায় রাজীবের মাথার আঘাত, রক্ত জমাট বেঁধে থাকা এবং খুলিতে চিড় ধরার ব্যাপারটি ভাবিয়ে তুলছে স্বজনদের। রাজীবের চিকিৎসার জন্য গঠিত মেডিকেল বোর্ডের প্রধান অধ্যাপক শামসুজ্জামান গতকাল গণমাধ্যমকে বলেন, রাজীবের মাথার সামনে ও পেছনের হাড় ভেঙে গেছে, ব্রেইনের সামনের দিকেও আঘাত পেয়েছে। তিনি জানান, আপাতত মাথার সার্জারি লাগবে না, তবে হাতের আঘাতের জায়গায় আরও কয়েকটা সার্জারি করতে হবে। মস্তিষ্কে জমাট রক্ত সরানোর জন্য ওষুধ দেওয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ওষুধে না সারলে অপারেশন করতে হবে। তার অবস্থা স্থিতিশীল দাবি করে তিনি জানান, হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা-ব্যয় বহন করা হচ্ছে। এর বাইরে বাড়তি ব্যয় নির্বাহ হচ্ছে পরিচালকের নিজস্ব তহবিল থেকে।
রাজীবের স্বজনরা জানিয়েছেন, মাঝে মাঝেই রাজীব তার বাম হাত দিয়ে হারানো ডান হাত খুঁজছেন। গতকাল (বৃহস্পতিবার) পানি ও ফলের রস খেয়েছিলেন। কিন্তু আজ (শুক্রবার) কিছুই মুখে তুলছেন না। কেমন লাগছে, জানতে চাইলে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। খালা খাদিজা বলেন, ‘ও আমার কাছেই বড় হয়েছে। ছেলেটা একেবারে ভেঙে পড়েছে। আর কেউ তো নেই ওর। এ পঙ্গু শরীরে ওর ভবিষ্যৎ যে কী হবে!’
জাতীয় সংসদের প্রধান হুইপ আসম ফিরোজও গতকাল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রাজীবকে দেখতে যান। তিনি রাজীবের নাম ধরে ডাকার পর রাজীব সাড়া দিয়েছেন বলে জানান সাংবাদিকদের। তিনি বলেন, তাকে বলেছি চিন্তা কর না, আমরা তোমার পাশে আছি, প্রধানমন্ত্রী তোমার পাশে আছেন। রাজীবের চিকিৎসায় মেডিকেল কর্তৃপক্ষ ও সরকার সব ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে বলেও জানান তিনি।
রাজীবের অবস্থা আশঙ্কামুক্ত নয় বলে এখনো নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখেছেন চিকিৎসকরা। তবে রাজীবের স্বজনসহ অনেকে মনে করছেন রাজীবকে দ্রুত আরও উন্নত চিকিৎসা করানো দরকার। প্রয়োজনে বিদেশে নিয়ে হলেও তাকে সুস্থ করতে হবে। রাজীবকে হারতে দেওয়া যাবে না।
প্রসঙ্গত, গত মঙ্গলবার বাস দুর্ঘটনায় রাজীবের হাত হারানোর পর বুধবার একটি রিটের পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত রাজীবের চিকিৎসার ভার বাসমালিকদের নির্দেশ দেন এবং কেন রাজীবকে এক কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে না জানতে চেয়ে রুল জারি করেন। এছাড়া বৃহস্পতিবার রাজীব হোসেনের হাত হারানোর ঘটনায় গ্রেপ্তার বিআরটিসি বাসের চালক ওয়াহিদ ও স্বজন পরিবহন বাসের চালক খোরশেদকে দুদিন করে রিমান্ডে পাঠিয়েছেন আদালত।

আদালতের নির্দেশে গা নেই কারও
দুই বাসের চাপায় হাত হারানোর পর তিতুমীর কলেজের ছাত্র রাজীব হোসেনের চিকিৎসার ব্যয় বহনের জন্য দুই বাসের মালিককে নির্দেশ দিয়েছিলেন আদালত। কিন্তু এখনো পর্যন্ত আদালতের সে নির্দেশ গা-ই করেননি বাস মালিকরা। এমনকি বাস মালিকদের কেউ রাজীবকে এ পর্যন্ত দেখতেও যাননি।
আদালতের নির্দেশের পর বাস মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্ল্যাহ জানিয়েছেন, স্বজন পরিবহনের কার্যালয়ে লোক পাঠিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি। ওই পরিবহনের মালিক কালু মিয়া এই মুহূর্তে বিদেশে রয়েছেন।
তিনি জানান, আজ (গতকাল শুক্রবার) কালু মিয়ার দেশে ফেরার কথা রয়েছে। দেশে ফেরার পর আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করবেন। কিন্তু গতকাল সন্ধ্যায় শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত স্বজন পরিবহন ও বাস মালিক সমিতির কেউ রাজীবকে দেখতে গেছেন- এমন খবর পাওয়া যায়নি।
গত মঙ্গলবার কারওয়ান বাজারে বিআরটিসি ও স্বজন পরিবহনের দুটি বাসের পাল্লা দিয়ে ছোটার সময় দুই বাসের চাপায় পড়ে দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় রাজীবের ডান হাত। ওই ঘটনার পরদিন বুধবার আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজলের করা রিটের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত দুই বাসের মালিককে রাজীবের চিকিৎসা ব্যয় নির্বাহের আদেশ দিয়েছিলেন। একইসঙ্গে রাজীবকে ১ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ কেন দেওয়া হবে না জানতে চেয়ে রুল জারি করেন। স্বরাষ্ট্র সচিব, সড়ক পরিবহন সচিব, পুলিশ প্রধান, ডিএমপি কমিশনারসহ আট বিবাদীকে চার সপ্তাহের মধ্যে ওই রুলের জবাব দিতে বলা হয়। পাশাপাশি যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিদ্যমান আইন কঠোরভাবে কার্যকর করার নির্দেশনা কেন দেওয়া হবে না এবং ভবিষ্যতে প্রয়োজনে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে আইন সংশোধন ও নতুন বিধিমালা প্রণয়নের নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না, তাও জানতে চেয়েছেন আদালত। আবেদনের প্রাথমিক শুনানি শেষে বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী ও বিচারপতি এ কে এম জহিরুল হকের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চ এ আদেশ দেন। এ সময় রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অরবিন্দ কুমার রায়।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *