শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৪:১৭ অপরাহ্ন

সাগরে ইলিশের সংকট, দাদন-ফাঁদে জেলেরা

বর্তমানকণ্ঠ ডটকম / ৮৪ পাঠক
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৪:১৭ অপরাহ্ন

গত মৌসুমে মহাজনের কাছ থেকে ছয় লাখ টাকা দাদন নিয়ে সাগরে ট্রলার পাঠিয়েছিলেন দেলোয়ার মাঝি। কিন্তু ইলিশের তেমন দেখা মেলেনি। দাদনের টাকাও শোধ করতে পারেননি। প্রতি যাত্রায় (ট্রিপ) লোকসান বাড়তে বাড়তে দেলোয়ারের নেয়া দাদনের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯ লাখ টাকায়। এ মৌসুমেও নদী ও সাগরে ইলিশের দেখা মিলছে না। তারপরও আরও তিন লাখ টাকা দাদন নিয়ে সাগরে ট্রলার পাঠিয়েছেন দেলোয়ার।

ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার সামরাজ ঘাটে কথাগুলো বলছিলেন চর মাদ্রাজ ইউনিয়নের চর মাদ্রাজ গ্রামের দেলোয়ার। চার সদস্যের সংসার তার। দিন দিন দাদনের বোঝা ভারী হওয়ার জন্য তিনি দায়ী করছেন ইলিশের সংকটকে। তবু কঙ্ক্ষিত পরিমাণে ইলিশ পেয়ে দাদনের বোঝা হালকা করে সুদিন ফিরবে– এমন প্রত্যাশা নিয়েই তিনি ও তার মতো অন্য মৎস্যজীবীরা চলতি মৌসুম শুরু করেছেন বলে জানালেন দেলোয়ার।

আগের বছরগুলোতে দাদন শোধ করে মুনাফা থাকলেও বছরদুয়েক হলো সেই ধারাবাহিকতায় ভাটা পড়েছে বলে জানালেন দেলোয়ার। তিনি বলেন, ‘দাদনের টাকা মহাজনকে শোধ দিয়ে যা থাকত তা ট্রলারের ১৩ মাঝিমাল্লার মধ্যে ভাগ করে দিতাম। নিজেরও কিছু থাকত। দুই মৌসুম ধরে আমাদের সবাইকে চলতে হচ্ছে ধারদেনা করে।’

সরকারের হিসাব বলছে, চরফ্যাশনের উপকূলীয় জেলেপল্লিতে বসবাস লক্ষাধিক ইলিশ শিকারির। তাদের প্রায় ৩২ শতাংশ সারা বছর এবং প্রায় ৫০ শতাংশ খণ্ডকালীন ইলিশ ধরার কাজে নিয়োজিত থাকেন। ইলিশ কেনাবেচা ও পরিবহনসহ সংশ্লিষ্ট কাজগুলোতে যুক্ত বাকিরা, তাদের সংখ্যাই প্রায় সাড়ে চার লাখ। বেসরকারি হিসাবে ইলিশ শিকারির সংখ্যা আরও বেশি।

জেলেরা বলছেন, একটা সময় নদী ও সাগর থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণে ইলিশ মিলত বলে ইলিশ শিকারে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত সবাই সচ্ছল জীবনযাপন করতেন। এখন ইলিশসংকটে সবাই বিপদে পড়েছেন। এ ছাড়া ইলিশ শিকারে নিষেধাজ্ঞার সময়ে সরকারি সহায়তা পাওয়া নিয়েও বিস্তর অভিযোগ জেলেদের। এই সহায়তার পরিমাণ বাড়ানোর পাশাপাশি প্রকৃত জেলেদের সহায়তাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করার দাবিও জানান জেলেরা।

একই উপজেলার আরেকটি বড় ঘাট ঢালচর। মৌসুমে দিনে বিভিন্ন এলাকার ৩০০ থেকে ৪০০ ট্রলারের আনাগোনা থাকে এই ঘাটে। এবার তা অর্ধেকে নেমে এসেছে। ওই ঘাটে কয়েকজন জেলে জানালেন, প্রতিবার সাগরযাত্রায় ট্রলারে অন্তত সোয়া লাখ টাকার পণ্য প্রয়োজন হয়। ১০-১৫ দিন পর মাছ নিয়ে ফেরেন তারা। অনেক সময়ই জেলেরা কাঙ্ক্ষিত পরিমাণে মাছ সংগ্রহে ব্যর্থ হন। এ রকম হলে সাগরযাত্রার খরচের দায়ও তাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেন মহাজন। প্রাথমিক দাদনের সঙ্গে তখন যুক্ত হয় খরচের টাকা।

জেলেরা বলছেন, এভাবে যতবার লোকসান হয়, ততবারই জেলে ও মাঝিমাল্লাদের দাদনের বোঝা বাড়তে থাকে। এর মধ্যে কোনো কোনো জেলে দাদন শোধ করতে এনজিও থেকে ঋণ নেন। তখন সেই কিস্তির চাপও ঘাড়ে চেপে বসে। গত মৌসুমের মতো এ মৌসুমেও প্রত্যাশা অনুযায়ী মাছ পাচ্ছেন না উল্লেখ করে জেলেরা বলছেন, এখন খেয়ে-পরে বাঁচাই কঠিন হয়ে পড়েছে।

ঢালচর ঘাটে কথা হয় জেলে আবদুর রবের সঙ্গে। ঢালচর গ্রামের এই বাসিন্দা পাঁচ সদস্যের সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। আগের বছর ৩০ হাজার টাকার সঙ্গে এ বছর ২৫ হাজার টাকা দাদন নিয়েছেন। সেই টাকা শোধ করতে না পেরে বাড়ি যেতে পারছেন না। এর মধ্যে স্থানীয় একটি এনজিও থেকে তিনি ৪০ হাজার টাকা ঋণ নেন। এখন সপ্তাহে এক হাজার টাকা করে কিস্তি টানছেন।

আবদুর রব বলেন, নিষেধাজ্ঞা শেষ হয়েছে। তবু নদী ও সাগরে ইলিশ মিলছে না। এ কারণে ট্রলারের মালিক, জেলেসহ সবার মাথায় ঋণের বোঝা। সামান্য যতটুকু মাছ মিলছে, তা দিয়ে ঋণ শোধ করে বাড়ি ফিরতে হচ্ছে একেবারে খালি হাতে।

সরকারি সহায়তা নিয়ে অভিযোগ জানিয়ে চর মাদ্রাজের চর নাজিমুদ্দিনের বাসিন্দা নুরুল ইসলাম মাঝি বলেন, জেলেদের খাদ্য-সহায়তা হিসেবে বিপুল পরিমাণ চাল বরাদ্দ দেখানো হয়। তবে এসব চাল প্রকৃত জেলেরা পান না। সমাজের নানা পেশার লোকজন নানা কৌশলে এই চালে ভাগ বসান। ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্যরা এই চাল বিতরণ করেন নিজেদের ঘনিষ্ঠদের মধ্যে। ফলে প্রকৃত জেলেদের বড় অংশ এ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন।

তবে দাদন ছাড়া মাছের ব্যবসা সম্ভব নয় বলে মনে করেন সামরাজ মৎস্যঘাটের আড়ত মালিক সমিতির সভাপতি মো. জয়নাল আবেদিন মিয়া। তিনি বলেন, প্রত্যেক মাঝিমাল্লাকেই দাদন দিতে হয়। নদ-নদীতে মাছের সংকট না থাকলে মৌসুমেই দাদন শোধ করতে পারেন জেলেরা। এক মৌসুমে পরিশোধ না হলে ওই দাদনের হিসাব পরের বছরে যোগ হয়। এ বছরে ইলিশের সংকট আছে। এ কারণে জেলেদের মতো বিপাকে আড়ত মালিকরাও।

মহাজনদের দাদনের চাপে জেলেরা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন– এমন অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে জয়নাল আবেদিন বলেন, দাদনের টাকার জন্য জেলেদের তেমন চাপ দেয়া হয় না। নদীতে মাছ ভালো থাকলে ইচ্ছামতো প্রতিটি ট্রিপের লভ্যাংশ থেকে দাদনের টাকা পরিশোধ করেন জেলেরা।

চরফ্যাশন উপজেলার জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা মারুফ হোসেন মিনার সরকারি সহায়তায় অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করলেও বরাদ্দের সীমাবদ্ধতার কথা স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, চরফ্যাশনে জেলের সংখ্যা বেশি। কিন্তু বরাদ্দের পরিমাণ সীমিত। উপজেলায় তালিকাভুক্ত জেলের সংখ্যা ৬০ হাজার। তাদের মধ্যে ৪৯ হাজার জেলে পুনর্বাসনের আওতায় সুবিধা পাচ্ছেন।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *