বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪, ০৪:৪৯ পূর্বাহ্ন

লড়াই যখন করোনার সাথে

বর্তমানকণ্ঠ ডটকম / ১৫৭ পাঠক
বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪, ০৪:৪৯ পূর্বাহ্ন

রুচিরা সুইটি, বর্তমানকন্ঠ ডটকম : জ্বরের সতেরো দিন পার করলাম! আমার অবশ্য পনেরো দিন, আজিমের দুই দিন পর আমার শুরু হয়। এই সতেরোটা দিন জীবনের অনেক হিসেব বুঝিয়ে দিল।

বৃহস্পতিবার অফিস থেকে ফিরে আজিমের জ্বর শুরু, সবসময়ের মতো আমার ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে আজিম বলল, ফ্যানটা আমি তার দিকে সরাসরি ঘুরিয়ে দিয়েছি বলেই তার জ্বর জ্বর লাগছে। আমি ও অপরাধী হয়ে মাথা টিপে দিচ্ছি, ওষুধ দিচ্ছি। দুজনেরই আশা তেমন কোন সমস্যা নেই। একদিন পার হয়ে যখন জ্বর চেপে বসে আর আমাকেও আক্রমণ করে তখনই দুজনের মনে আশঙ্কা জাগে ভয়াবহ কিছুর।

যুদ্ধটা কঠিন ছিল, বাসায় দুইটা ছোট বাচ্চা আমাদের। সরকারি বেসরকারি দুই হাসপাতালের ডাক্তারই করোনা সন্দেহ করে সবরকম সতর্ক থাকার পরামর্শ দেয়। বাচ্চাদের আলাদা করে দিতে বলে। যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলাম আমরা।

অনেক রকম প্রচলিত চিকিৎসা জানা ছিল, সবগুলোই শুরু করলাম। অন্যসবাই কতটা লাভবান হয়েছে জানি না, আমরা বিপদেই পড়লাম। মশলাযুক্ত গরম চা দুই দিন খাবার পরেই স্টমাক পুরোপুরি বিদ্বেষী হয়ে উঠে, এমনিতেই খাবার খাওয়া বন্ধ, রুচি সম্পূর্ণ চলে গেছে তার সাথে শুরু হয় ডায়রিয়া, বমি, আর শ্বাসকষ্ট। স্যালাইন খেলে গলা ব্যাথা শুরু হয়, ফল খেলে পেট খারাপ হয়ে যায়, খাবার খেলে জিভ ছিলে যায়, শুয়ে থাকলে শ্বাস নিতে পারিনা, বসে থাকলে মাথা ঘুরে, দাড়িয়ে থাকা তো অসম্ভব। বাচ্চা দুইটা অসহায় মুখে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। তাদের সাথে খুব স্বাভাবিক ভাবে হেসে হেসে কথা বলতে হয়, সময় নিয়ে বুঝিয়ে বলতে হয়।

কি খেয়ে যুদ্ধ করেছি? গরম পানিতে লবন দিয়ে টক দই এর শরবত, আর লবংগ দিয়ে পাতলা আতপ চালের জাউ..এই দুই টা খাবার গলা ও পেট দুই ঠান্ডা রেখেছে..গরম পানির ভাপ আর ইস্ত্রী করে তোয়ালে গরম করে গলা, বুকে হালকা হালকা সেক দিয়েছি। অনেক অনেক কষ্ট করে ব্যায়াম করেছি, ব্যায়াম করার পরেই জ্বর চলে আসতো, কিন্তু পরদিন অনেক ভালো লাগতো। কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন এর “দম নিন দম ছাড়ুন” মেডিটেশন টা কি যে প্রশান্তি দিয়েছে। প্রচন্ড শরীর খারাপের সময় শুধু কোরান তেলাওয়াত শুনেছি। একটু ভালো লাগলে শুনেছি শচীন দেব বর্মন এর গান। দেখেছি কুইন, ওয়েক আপ সিড, থ্রি ইডিয়টস.. বালিশে হেলান দিয়ে শুধু তাকিয়ে থাকতে ও এতো কষ্ট হতো। মনটা কে ব্যাস্ত রাখতে অনেক কিছু লিখেছি, হাত কাঁপত, চোখ ঝাপসা লাগতো, তবু অসুখ থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে চেয়েছি। আমার সেই লেখা গুলো প্রিয় “পেন্সিল”.. প্রকাশ করে অনেক সাহায্য করেছে। পেন্সিল পাঠকের কমেন্টের জবাব দিতে দিতে অনেক সময় পার হয়ে গেছে। বন্ধু আশা, আঁখি ভাবি আর দেবতা তুল্য মামা মামি এই সময়ে যা করেছে তা সারা জীবন মনে রাখব।

ওষুধ খেতে হয়েছে অনেক, প্যানাডল, এজিথ্রোমাইসিন, ফ্লাজিল, গ্যাস এর ওষুধ, বমির ওষুধ ইত্যাদি ইত্যাদি। দিনে অনেক অনেক বার বাথরুম পরিস্কার করতে হয়েছে খুবই কষ্ট করে, যেহেতু আমাদের আর বাচ্চাদের একটা বাথরুম। দেশে দুই পরিবারের বাবা মা ভাই বোনের যথেষ্ট চোখের পানি ঝরিয়েছি, দোয়া ও পেয়েছি অনেক। হাসপাতালে যাবার পর যখন বাচ্চা দুই টা বাসা থেকে এস এম এস করলো, বাবা মা তোমরা ভয় পেও না, আমরা আছি.. তখন দুই জামাই বৌ গলা জড়াজড়ি করে কেঁদেছি।

ঈদের দিন সরকারি হাসপাতাল থেকে ফোন করে বলল, আমি এবং আজিম দুজনেরই করোনা পজিটিভ । জ্বর শুরু ৭মে তে, হাসপাতালে টেস্ট এর জন্য গেলাম এগারো মে, টেস্ট করার ডেট পেলাম সতেরো মে, আর টেস্ট এর রেজাল্ট পেলাম চব্বিশ মে, এতোদিন পরে জেনে কি করব আর বলতে পারেন? ঈদের দিন থেকেই আলহামদুলিল্লাহ সুস্থ বোধ করছিলাম আমরা।

লেখাটা তাদের জন্য যারা এই মুহূর্তে করোনার সাথে লড়াই করছেন কিংবা কিছুদিন পর লড়াই করবেন। আমি মূলত সৌদি প্রবাসী ব্যাচেলর ভাইদের কথাই বলছি। একটা কথা ভালো করে জেনে নিন, করোনা ভাইরাস এর সরাসরি কোন চিকিৎসা আজ পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয় নাই, এই ভাইরাস এ আক্রান্ত হয়ে শতকরা আশি ভাগ মানুষ ঘরে বসেই সুস্থ হচ্ছে। তাই হাসপাতালে যাবার জন্য ব্যাস্ত হবার কিছু নেই। কেবলমাত্র শ্বাস কষ্ট না হলে আপনার হাসপাতালে যাবার কোন প্রয়োজন নেই। আর শ্বাস কষ্ট হচ্ছে কিনা সেটা বুঝতে হলে, আপনি খেয়াল করুন আপনার নাভি মিনিটে কতবার উঠানামা করছে, পঁচিশ বা তার বেশী বার উঠানামা করলে শ্বাস কষ্ট ধরতে হবে। একজন সুস্থ মানুষের সেটা হবে পনেরো থেকে বিশ বার। নিয়মিত শ্বাস এর ব্যায়াম করুন।
আপনাকে মানসিক ভাবে শক্ত হতেই হবে। মনের জোরে আশি বছরের বৃদ্ধ কেও এই রোগে সুস্থ হতে দেখছি আর মনের দূর্বলতায় বিশ বছরের যুবক ও কাবু হয়ে যাচ্ছে। কাজেই মনের জোর খুব ই প্রয়োজন। লক্ষন প্রকাশ পাওয়া মাত্রই প্রতিরোধের জন্য প্রস্তুত হতে হবে। ব্যাচেলর মেসে যারা থাকেন সেখানে কেউ আক্রান্ত হলে সবাই কে একযোগে সেটা মোকাবেলা করতে হবে। যিনি অসুস্থ তাকে একটা রুমে আলাদা করে দিন, যারা সুস্থ তারা দরকার হলে একরুমে কয়েক জন বেশি থাকবে তাই বলে তো অসুস্থ মানুষ কে বের করে দিতে পারেন না। যিনি অসুস্থ তার খাবার রুমের সামনে রেখে আসতে হবে, বাথরুম ব্যবহার এর পর ডেটল দিয়ে পরিস্কার করতে হবে। যিনি অসুস্থ তার দায়িত্ব এটা খেয়াল করা যেন তার কাছ থেকে একজন মানুষ ও আক্রান্ত না হয়, আর যিনি সুস্থ তার দায়িত্ব সাধ্যমত অসুস্থ মানুষটি কে সাহায্য করা। সবাই মিলে চেষ্টা করলে তবেই তো আমরা এই যুদ্ধে জয়ী হতে পারবো।

শুধু জ্বর হলে প্যানাডল খাবেন তিন বা চার বেলা, একটু বেশি জ্বর সাথে ঠান্ডা বা কানে গলায় ব্যাথা, অথবা পেট খারাপ হলে এজিথ্রোমাইসিন এন্টিবায়োটিক টি ফার্মেসির পরামর্শ অনুযায়ী খান। পেটের সমস্যা বেশি হলে সাথে ফ্লাজিল, বা ইমোডিয়াম খেতে পারেন। গ্যাস এর ঔষধ নিজের কাছে যেটা ভালো লাগে খান। দুই থেকে আড়াই লিটার পানি বা তরল খাবার নিন। যে খাবার আপনার পেট ঠান্ডা রাখে সেগুলো ই খেতে চেষ্টা করুন। অবশ্যই অবশ্যই ব্যায়াম করবেন। নিয়মিত দুই বেলা গোসল করবেন। গরম পানির ভাপ নিন। প্রথম এগারো দিন পার করতে পারলে সাধারণত ভয়ের কিছু আর থাকে না। যদিও প্রায় মাস খানেক লাগে সম্পূর্ণ ঠিক হতে। তবে মনের জোর নিয়ে চেষ্টা করলে আপনি সুস্থ হবেন ই ইনশাল্লাহ।

আরও একটি কথা না বললেই নয়, যে ডাক্তার, যে বন্ধু বা যেই আত্মীয় স্বজন আপনি করোনা আক্রান্ত জেনেও আপনার ভয় দেখাবে, কয়জন করোনায় মারা গেছে, কে দুই দিনের জ্বরে হার্ট এ্যাটাক করেছে এইসব খবর দিবে তাদের সাথে এই সময়ে সম্পূর্ণ যোগাযোগ বন্ধ রাখবেন। একমাত্র তাদের সাথেই যোগাযোগ রাখতে হবে যারা আপনাকে মনের জোর দিবে। ফেসবুক থেকেও দূরে থাকুন। নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি এগুলো আপনাকে শুধুমাত্র মানসিক অস্থিরতা দিবে আর কিছুই নয়।

খাবার বা ঔষধ নিয়ে কেউ যদি বিশেষ বিপদে থাকেন তাহলে এই পত্রিকার মাধ্যমে দূতাবাস বা আমাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন। সবার সার্বিক কল্যাণ কামনা করছি। আল্লাহ সবাই কে নিরাপদে রাখুক।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *